JuboKantho24 Logo

আফটার স্কুল মাকতাব : প্রাথমিক ধর্মশিক্ষায় নতুন প্রয়াস

২৬ নভেম্বরের আলোঝলমল সকাল। সবাই অবাক হয়ে দেখছে, দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত এক স্কুলছাত্রের মাথায় পুরো কুরআন হিফজের স্বীকৃতিস্বরূপ পরানো হয়েছে পাগড়ি। হাতে তুলে দেয়া হয়েছে সনদ এবং ওমরার প্রতীকী টিকেট। আজকের অনুষ্ঠানের সৌন্দর্যই এটা৷ কেবল মাকতাবে পড়েও যে হাফেজ হওয়া যায়, তারই দৃষ্টান্ত ইউশা আমিন। কিশোরগঞ্জের দারুল আরকাম ইনস্টিটিউটের আফটার স্কুল মাকতাব শাখা সম্পন্ন করে হেফজ শাখায় পড়ে ইউশা ইয়ামিনের মতো হাফেজ হবার পথে এগুচ্ছে আরও অনেক স্কুল ছাত্র।

স্কুল-কিন্ডারগার্ডেন কিংবা কোচিংয়ে পড়ার কারণে অনেকেই সকালবেলার মাকতাবে যেতে পারে না। নিতে পারে না ধর্মীয় শিক্ষার প্রথম পাঠ। পড়ে উঠতে পারে না কুরআন। স্কুল-কিন্ডারগার্ডেন কিংবা কোচিংয়ের টাইম-শিডিউলে সকালবেলার মাকতাব হারাচ্ছে গুরুত্ব। তাই মাকতাবের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিক্ষায় শিশুদের শিক্ষিত করে তুলতে শুরু হয়েছে আফটার স্কুল মাকতাব। স্কুল ছুটির পর বিকেলে বা সন্ধায় এই মাকতাবে পড়তে পারে শিক্ষার্থীরা।

আফটার স্কুল মাকতাব শাখা সম্পন্ন করে হাফেজ হবার পথে এগুচ্ছে ছাত্ররা। কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যমতে, ২০ পারা হিফজ করেছেন একজন। ১৫ পারা হিফজ করেছেন একজন৷ পাঁচপারার উপর হিফজ করেছেন ১১ জন। ফজিলতের সূরা, যেমন সূরা ইয়াসিন, ওয়াকেয়া, আর-রহমান, দুখান, কাহাফ ইত্যাদি সূরা হিফজ করেছেন ৩৯জন। ২৬ নভেম্বরের অনুষ্ঠানে কুরআন সবক গ্রহণ করেন আরও ১৫২ জন ছাত্র। চলতি বছর এই মাকতাবের অধীনে কুরআন খতম করেন ৭০ জন শিক্ষার্থী। এছাড়াও গাইবান্ধার একটি স্কুলে এই মাকতাবের কারিকুলামে কুরআনের সবক নিয়েছেন ৩৫০ জন শিক্ষার্থী।

আফটার স্কুল মাকতাব: তিন ধাপ

বিলুপ্ত হতে থাকা সকালবেলার মাকতাবশিক্ষা রক্ষা করতেই ২০০৯ সালে শুরু হয় আফটার স্কুল মাকতাব। স্কুলশিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে তৈরী হয় সিলেবাস। প্রচলিত মাকতাবশিক্ষাকে সাজানো হয় যুগোপযোগী করে। স্কুল শেষ হবার পর বিভিন্ন ব্যাচে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। এই মাকতাব কার্যক্রমের তিনটি ধাপ।

এক. আফটার স্কুল মাকতাব: নার্সারি থেকে ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা এই ধাপে পড়েন। এখানে কায়দা এবং কুরআনের পাশাপাশি দ্বীনের বুনিয়াদি বিষয়গুলো পড়ানো হয়।

দুই. আফটার স্কুল হিফজ: ৫ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এখানে পড়ে। যারা মকতব শেষ করতে পারে, তাদেরকেই মূলত এখানে সুযোগ দেয়া হয়।

তিন. আফটার স্কুল শরিয়া কোর্স: এটি ১০ম শ্রেণির উপরের শিক্ষার্থীদের জন্য। এখানে মূলত পড়ানো হবে শরিয়তে মৌলিক বিষয়গুলো। প্রচলিত মাসআলা, আরবি ল্যাঙুয়েজ, যেন একটি ছেলে অন্তত কুরআন তরজমা করতে পারে। এ শাখাটি এখনও শুরু হয়নি। আগামী বছর শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

আফটার স্কুল মাকতাব সিলেবাস

সকাল বেলার মাকতাবগুলো কোনো নিয়মের অধীনে পরিচালিত হতো না। ছিলো না কোনো সিলেবাসও। যুগের প্রেক্ষিতে তাই আফটার স্কুল মাকতাব নিয়ে এসেছে পরিকল্পিত সিলেবাস। এতে মোট ৮টি বিষয় পড়ানো হয়।

১. কায়দা-কুরআন: হরফ থেকে শুরু করে বিশুদ্ধভাবে কুরআন খতম। সূরা দুহা থেকে নাস পর্যন্ত ২৩টি সূরা মুখস্থকরণ। এছাড়াও বিশেষ ফজিলতের সূরাগুলো মুখস্থকরণ।

২. মাসনুন দোয়া: ৪০টি মাসনুন দোআ এবং বিভিন্ন কর্মের সুন্নত শিক্ষাদান। পাশাপাশি ফজিলতপূর্ণ আমলগুলোও পাঠদান।

৩. আকাইদ: ইসলামের মৌলিক আকিদাগুলো পাঠদান। পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালার ৯৯ নাম মুখস্থকরণ।

৪. নামাজশিক্ষা: ওয়াক্তিয়া নামাজ থেকে শুরু করে জুমা, ঈদ, সালাতুল হাজত, জানাজা ইত্যাদি নামাজ শিক্ষা।

৫. ফিকহ: তাহারাত ও সালাতের ফিকহি বিধানগুলো পাঠদান। পাশাপাশি হজ, যাকাত, রোজারও সংক্ষিপ্ত পরিচয়দান।

৬. হাদিস: সামাজিকতা, লেনদেন, ঈমান ও ইবাদত সম্পর্কিত ৪০ হাদিস মুখস্থকরণ।

৭. সিরাতুন্নবি: প্রশ্নোত্তরে রাসুলের সিরাত পাঠ।

৮. ইসলামি ইতিহাস: ১০০টি প্রশ্নোত্তরে ইসলামি ইতিহাসের বিশেষ পাঠদান।

অভিভাবকদের আগ্রহ বাড়ছে

আফটার স্কুল মাকতাব নিয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠিতা পরিচালক মাওলানা আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি জানান, তাদের মাকতাব কারিকুলামে ইতোমধ্যেই ৮০০ জন প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ২৫টি জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় ২৫০টি শাখা। শাখা খোলা হয় ভাড়া বাসায়। কোথাও কোথাও মসজিদেও খোলা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের আগ্রহ বাড়ছে। তারা এসে যখন সিলেবাস দেখেন, কেউ ফিরে যান না। স্কুল শেষে মাত্র একঘণ্টায় নিয়মিত পড়ে তাদের সন্তানরা দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো জানতে পারবে, এতেই তাদের ভরসা। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সন্তানরাও এই মাকতাবে পড়ছে। কিন্তু কথা হলো, প্রথমেই সবাই এসে মাকতাবে সন্তান দিয়ে যাবে না। তাদেরকে বুঝাতে হবে। বুঝাতে পারলে অবশ্যই সন্তানকে মাকতাবে দিবে।’

তিনি বলেন, ‘দেশের বড় বড় আলেমগণ আমাদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের দোয়া, নির্দেশনা ও পরামর্শ নিয়েই চলছি। তবে যদি মসজিদে মসজিদে এই মাকতাব চালু করা যেতো, তাহলে প্রসারটা আরও বেশি হতো। কারণ, মসজিদে পরিবেশ তৈরীই থাকে। নতুন জায়গায় মাকতাব খুলতে গেলে বাসা ভাড়া নিতে হয়, সরঞ্জাম কিনতে হয়, শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয়। কিন্তু মসজিদে ত ইমাম থাকেনই৷ তিনিই শিক্ষক হতে পারেন। তাই যদি দেশের তিন লক্ষ মসজিদে আফটার স্কুল মাকতাব চালু করা হয়, তাহলে ৫ কোটি স্কুলশিক্ষার্থী উপকৃত হতে পারবে।’

আফটার স্কুল মাকতাব যুগান্তকারী পদক্ষেপ

এ প্রসঙ্গে কথা হয় আলেম লেখক ও অধ্যাপক সাইফ সিরাজের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, উপমহাদেশে যখন সাবাহী মক্তবগুলো পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করা হচ্ছে আর দেয়া হচ্ছে আধুনিক পড়াশোনার দোহাই, তখন আফটার স্কুল মুনাজ্জাম মাকতাব উম্মতের জন্য এক পশলা শান্ত বৃষ্টির পরশের মতো। জীবনের জন্য অক্সিজেন যেমন, উম্মতের জন্য, উম্মতের শিশুদের জন্য এই মক্তব আন্দোলন তেমনই। এর কারিকুলাম দেখে মনে হয়েছে, একজন মুমিনের ফরজি ইলমের জন্য এই কারিকুলাম একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।’

সাইফ সিরাজের পর্যবেক্ষণ মতে, সাধারণ জনগণের জন্য দারুল আরকামের এই আফটার স্কুল মুনাজ্জাম মাকতাব খুবই জরুরী। সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।

কথা হয় লেখক ও অনুবাদক আব্দুল্লাহ আল ফারুকের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানির সাহেবজাদা মাওলানা আসআদ মাদানি আমার শিক্ষক ছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দে পড়াকালীন প্রতিদিন বিকেলে তার মজলিসে উপস্থিত হতাম। তিনি বলতেন, ‘উপমহাদেশে অনেক মাদরাসা তৈরি হয়েছে। তৈরি হচ্ছে দেশ সচেতন আলেম। এখন দরকার ইসলামি স্কুল তৈরি করা।’ আমরা চাইলেই এখন হাজার হাজার ইসলামি স্কুল তৈরি করতে পারব না। কিন্তু চাইলেই আফটার স্কুল মকতবের মাধ্যমে প্রচলিত স্কুলগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষাটা দিতে পারি। তাতে আমাদের আগামী প্রজন্ম ধর্মহীনতার স্রোত থেকে রক্ষা পাবে।

Jubokantho24 Ad
এ জাতীয় আরো সংবাদ
এ জাতীয় আরো সংবাদ