
ইসলামের সোনালী যুগ থেকেই ইলমের জন্য সফরের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সেই ধারা অনুসরণ করে ইলমপিপাসু শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি বিশ্নজুড়ে ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে ছুটে চলেছেন।
এক্ষেত্রে জ্ঞানপিপাসু বাংলাদেশি কওমি শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে নেই। তারাও বিশ্বের স্বনামধন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য ছুটে যাচ্ছেন। মেধা ও কৃতিত্বের অনন্য সাক্ষর রেখে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় কা’বাতুল ইলম খ্যাত হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েও দলে দলে ছুটে আসছেন কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। পৃথিবীর প্রাচীনতম এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বলা যায়, বর্তমানে কওমি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু কিভাবে আসবেন বা আসার পূর্বে কী কী প্রস্তুতি নিবেন অথবা আসার পরে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে ভর্তি হবেন ইত্যাদি নানা বিষয়ে সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা না থাকাই বিভিন্ন জটিলতা ও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
আজকের এ প্রতিবেদনে আমরা ধাপে ধাপে প্রতিটি বিষয় তুলে ধরবো তবে তার পূর্বে বাংলাদেশ থেকে যারা স্কলারশিপ নিয়ে আসতে আগ্রহী তাদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি আল আজহার কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর সীমিত পরিসরে অল্প কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত জানার জন্য ২০ মার্চ ২০১৯ সালে এ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি দেখে নেওয়া যেতে পারে।
সম্প্রতি নন স্কলারশিপ বা ব্যক্তিগত খরচে বহু শিক্ষার্থী এসেছেন এবং খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে নিজ খরচে আসার আগ্রহ সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে আজকের প্রতিবেদনে এ সম্পর্কিত নানা তথ্য বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
★সিদ্ধান্ত গ্রহন : এক্ষেত্রে মৌলিক তিনটি বিষয় সামনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত : আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া লেখা দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ একটি ব্যাপার। বিশেষত কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য।
মাস্টার্স সমমানপ্রাপ্ত দাওরায়ে হাদিস বা মেশকাত জামায়াতের সার্টিফিকেটের এখানে কোনো মূল্যায়ন না থাকাই অনার্স লেভেল পর্যন্ত পৌঁছতে যোগ্যতা ভেদে দুই থেকে ছয় বছর লেগে যেতে পারে।
অবশ্য বর্তমানে আল-আজহার কর্তৃপক্ষ প্রকৃত যোগ্য ছাত্ররা যাতে সরাসরি অনার্সে উঠতে পারে সে জন্য বিশেষ একটি পরীক্ষার আয়োজন করে থাকে যা বছরে সাধারণত একবার অনুষ্ঠিত হয়।
এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গেলে শরহে বেকায়ার অ্যাটাস্টেড সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয়।
অনার্সের মেয়াদকাল চার বছর এবং মাস্টার্স ও এমফিল নূন্যতম তিন বছর, সর্বমোট পাঁচ বছর।
দ্বিতীয়ত : পরিবেশ ও সংস্কৃতির ভিন্নতা। মিশর মুসলিম প্রধান দেশ হলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত বৃটিশ উপনিবেশ থাকায় জনসাধারণের পোশাক-আশাক অনেকটাই ইউরোপিয়ান ধাঁচের। এছাড়াও দাড়ি বা এজাতীয় কিছু বিষয়ে রয়েছে বেশ শিথিলতা। সাথে রয়েছে মাযহাবের ভিন্নতা। কাজেই কওমি অঙ্গন থেকে এসে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে চলা আপনার পক্ষে কতটুকু সম্ভব তাও লক্ষণীয়।
তবে উল্লেখ্য যে আল আযহার কর্তৃপক্ষ সালাফি মতবাদকে খুব কঠোর ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি ভর্তির সময় চার মাযহাবের যে কোনো এক মাযহাবের অনুসারী হতে হয় নতুবা সে ভর্তির অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নারী পুরুষ অবাধ মেলামেশার কোনো সুযোগ নেই এখানে ।
তৃতীয়ত : আর্থিক সক্ষমতা। ভিসা প্রসেস এবং বিমানের টিকিট মূল্য বাবদ প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকা খরচের সামর্থ্য থাকা। এর কম বেশি হতে পারে।
মিশরে আসার পর প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকার মধ্যে স্বাচ্ছন্দে চলা যায়। এরমধ্যে থাকা-খাওয়া, বাসা ভাড়া সবই অন্তর্ভুক্ত। যদিও ছয় থেকে আঁট হাজার টাকার মধ্যে চলা যায় তবে তা কষ্টকর।
আর বর্তমানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অধিক সমাগম হওয়ায় স্কলারশিপ দুই বা তিন বছরের পূর্বে না হওয়ার সম্ভাবনায় প্রবল।
তবে শর্তসাপেক্ষে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার অনুদান নেওয়া বা তাদের পরিচালিত ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ রয়েছে। যে সংস্থাগুলো শিক্ষার্থীর থাকা খাওয়ার খরচ বহন করে এবং মাসিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ হাতখরচ প্রদান করে থাকে।
উল্লেখ্য যে ভিন্ন সংস্কৃতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখতে বা আগ্রহের ফন চয়নের ক্ষেত্রে অথবা যাবতীয় সকল বিষয় জানতে বর্তমান আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অথবা বাংলাদেশের বিভিন্নপ্রান্তে দ্বীনী খেদমতে নিয়জিত বিজ্ঞ আজহারী আলেমদের সাথে পরামর্শ করা যেতে পারে। সোশাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়।
নূন্যতম যে সকল যোগ্যতা নিয়ে আসবেন-
মনে রাখবেন এখানে কিতাবাদি বা প্রশ্নপত্র ইত্যাদি সব কিছুই আরবি ভাষায় লিখিত তবে তা সাবলীল ও সহজে বোধগম্য, দুর্বোধ্য নয়। অতএব মধ্যম মানের যে কোনো আরবি কিতাব পড়ে বুঝতে পারার যোগ্যতা অর্জন করে তবেই আসা উচিৎ ।
এছাড়াও ‘শ্রবণ দক্ষতা’ অর্জন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিশরে বিশুদ্ধ আরবি ভাষার ব্যবহার বা প্রচলন খুবই কম। প্রায় সবখানে আঞ্চলিকতার ছড়াছড়ি সাথে উচ্চারণেও রয়েছে ভিন্নতা।
সুতরাং শ্রবণে যার দক্ষতা যত বেশি থাকবে উস্তাদ বা ডক্টরগণের লেকচার দ্বারা সে তত বেশি উপকৃত হবে।
এক্ষেত্রে নিয়মিত ডক্টর আলী মোল্লা অথবা শায়েখ মুহাম্মাদ হাসসান বা মিশরীয় বড় বড় ইসলামিক স্কলারদের বক্তব্য, টকশো ইত্যাদি শুনলে উক্ত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
একই সাথে যে কোনো প্রয়োজনে নিজের মনের ভাব আরবিতে প্রকাশের যোগ্যতা থাকা উত্তম।
যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিগত কাগজপত্র থাকতে হবে-
১- শরহে বেকায়ার মার্কসিট সহ সার্টিফিকেট।
২- উক্ত প্রতিষ্ঠান হতে তাযকিয়া/আপনি যে উক্ত প্রতিষ্ঠানে পড়েন তার প্রমান স্বরূপ।
৩- সম্পূর্ণ প্রস্তুতকৃত পাসপোর্ট (সর্বনিম্ন একবছর মেয়াদ থাকতে হবে)।
৪- পাসপোর্ট সাইজের ব্যাক্তিগত ছবি, (সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে)। ছবিটি হোয়াটসঅ্যাপ/ ইমেইলে পাঠানোর উপযুক্ত হওয়া।
৫- অনলাইন জন্ম নিবন্ধন।
৬- চেয়ারম্যান/কাউন্সিলর সার্টিফিকেট।
৭- পুলিশ ক্লিয়ারেন্স।
৮- প্রতিটি ডকুমেন্টস-এর তথ্য একই রকম হওয়া। এমনকি নাম, পিতার
নাম ইত্যাদির বানানে পার্থক্য না থাকা।
৯- মিশরে আসার পূর্বে সকল ডকুমেন্টস আরবিতে অনুবাদ করা ও অ্যাটাস্টেড করা।
১০- পাসপোর্ট এর আরবি অনুবাদ করা।
১১- হিফজ, মেশকাত, দাওরা হাদিস ইত্যাদি সকল একাডেমিক সার্টিফিকেট (যদি থাকে) আরবি অনুবাদ ও সত্যায়ন করে আনা উত্তম।
যাদের মাধ্যমে আসবেন –
মাধ্যম যাচায়ে অবশ্যই আপনাকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে নতুবা সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখরোচক বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারিত হওয়ার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হতে পারে যদি মিশরে আপনার পূর্ব পরিচিত কেউ থেকে থাকে তাহলে তার সাথে যোগাযোগ করে আসা অথবা মিশরের কায়রোস্থ সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম ‘ইত্তেহাদের’ দায়িত্বশীলদের সাথে যোগাযোগ করে বিকল্প কোনও নিরাপদ মাধ্যম খোঁজ করা ।
আসার পর করণীয়-
এ দেশে আসার পর সাধারণত এক বা দুই মাসের মধ্যেই আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সম্পন্ন করা যায়।
ভর্তির পূর্বে মেডিকেল টেস্ট এবং এম্বাসি লেটার নেওয়া সহ যাবতীয় কার্যক্রম সাধারণত আপনি যাদের মাধ্যমে আসবেন তারাই করে দেবে। তবুও দেশে থাকতে এ ব্যাপারে ভালো ভাবে নিশ্চিত হয়ে নিবেন।
(ভর্তি পরবর্তী অনার্স লেভেল পর্যন্ত যেভাবে পৌঁছাবেন)
ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর ছয় স্তর বিশিষ্ট আরবি ভাষার উপর একটি কোর্স সমাপ্ত করতে হবে। প্রতিটি স্তরের মেয়াদকাল প্রায় ৪৫ দিন। তবে এ কোর্স শুরুর পূর্বে স্তর নির্ণয়ের একটি পরিক্ষা দিতে হবে যা সাধারণত প্রতি দু’মাস অন্তর একবার হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যে যত উপরের স্তর পাবে তার ভাষা কোর্স তত দ্রুত সমাপ্ত হয়ে যাবে।
পূর্ব বর্ণনা অনুযায়ী কওমি সার্টিফিকেটের কোনো মূল্যায়ন না থাকায় কোর্স শেষে আপনি ধাপে ধাপে এ’দাদী তিন বছর, সানূভী তিন বছর, মোট ছয় বছর শেষ করে অনার্সে উঠার সুযোগ পাবেন। এটি অনার্সে উঠার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
তবে একটি পরিক্ষার মাধ্যমে এ’দাদীর তিন বছর একবারে অতিক্রম করে এবং অনুরূপ আরাকটি পরিক্ষার মাধ্যমে সানূভীর তিন বছরকে এক বা দুই বছরে সমাপ্ত করে অল্প সময়ে অনার্স পর্যন্ত পৌছার সুযোগ রয়েছে।
এছাড়াও দ্বিতীয় যে সুযোগটি বর্তমানে চালু হয়েছে তা হলো এ’দাদী ও সানূভীর পুরো ছয় বছরের উপর অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরাসি অনার্সে উঠে যাওয়া। এগুলোর সব কিছুই নির্ভর করে আপনার যোগ্যতার উপর।
তবে বলা বাহুল্য যে কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য অনার্সের পূর্বের ধাপগুলো অতিক্রম করা বেশ সহজ। পরিকল্পিত অল্প পরিশ্রমেই এ সকল ধাপ অতিক্রমের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া কোন্ কোন্ কিতাবাদীর মাধ্যমে প্রস্তুতি নিতে হবে বা পরীক্ষার ধরন, প্রশ্নপত্র কেমন হবে ইত্যাদি নানা বিষয় অনায়াসে জেনে নেওয়া সম্ভব মিশরে আসার পর কওমি শিক্ষার্থীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।
সর্বোপরি পুণ্যভূমি মিশর হতে পারে বহুমুখী জ্ঞান অর্জনের কাঙ্ক্ষিত একটি স্থান। যেখানে আপনি বিশ্বখ্যাত আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের পাশাপাশি
– ঐতিহাসিক আজহার মসজিদ প্রাঙ্গণে বিশ্ববরেণ্য প্রখ্যাত মিশরীয় ডক্টরগণ কতৃক পরিচালিত ‘উন্মুক্ত শিক্ষাকার্যক্রমে’ অংশগ্রহণ করে শিখতে পারেন আপনার পছন্দের বিষয় এবং কোর্স শেষে পেতে পারেন ডক্টরগণ কর্তৃক প্রদত্ত সনদ।
– অথবা পছন্দের শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ডক্টরের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থেকে হতে পারেন শাস্ত্রীয় বিশেষজ্ঞ।
– পুরো কুরআন শুনিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত কারীদের থেকে নিতে পারেন কেরাআতের উপর আন্তর্জাতিক মানের সনদ।
– দেশি বিদেশি বিভিন্ন ভাষা ইনস্টিটিউটে রয়েছে স্বল্প খরচে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ।
এছাড়াও রয়েছে জ্ঞানার্জনের আরো নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা। প্রয়োজন শুধু উচু হিম্মত ও দৃঢ় মনোবলের।
সঠিক প্লান,চেষ্টা ও পরিশ্রমের এবং দোয়ায় আল্লাহ তা’য়ালাকে বেশি বেশি স্মরণের। আল্লাহ সর্বোত্তম তাওফিক দাতা।




