|| তাসনিফ আবীদ ||
২০১৮ কওমি মাদরাসা ছয় বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়া অধীনে কওমি মাদরাসা সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সরকারী স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। সময়ের ব্যবধানে এই স্বীকৃতি আদায়ের ৫ বছর পেরিয়েছে। প্রায় অর্ধ যুগের কাছাকাছি এই সময়ে ‘স্বীকৃতি’র কতটা সুফল ভোগ করতে পেরেছে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা? কওমি সনদের স্বীকৃতি কতটাই বা বাস্তবে কার্যকর হয়েছে? এসব প্রশ্ন এখন বেড়েই চলছে।
স্বকীয়তা বজায় রাখতে ৬ শর্তে কওমি সনদের স্বীকৃতি গ্রহণ করতে রাজি হয় হাইয়াতুল উলিয়া। সরকার সব শর্ত মেনে নিয়ে স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু প্রদত্ত এই স্বীকৃতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কী কী সুফল পেয়েছে জানতে চেয়েছিলাম ঢাকার দারুল উলুম বনশ্রী মুহাদ্দিস মাওলানা মাসুম আব্দুল্লাহ কাসেমীর কাছে। তিনি বলেন, যেভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, এর মাধ্যমে বাস্তবে কোনো ফায়দা হাসিল হবে না এটা প্রায় সবারই জানা ছিল। গত ৫ বছরে এটা এখন আরো ভালোভাবে উপলব্ধি হয়েছে। আসলে প্রকৃত পক্ষে কওমি সনদকে যেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার ছিল, সরকার সেভাবে দিতে পারবে না। আর সরকার যেভাবে দিয়েছে, এর মাধ্যমে কওমি ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো সুফলও পাবে না।
স্বীকৃতি বিষয়ে ছাত্রদের কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে নেতৃবৃন্দদের কথা জানিনা তবে কওমি শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই বুঝেছিল এই স্বীকৃতি তাদের কোনো উপকার বয়ে আনবে না। তাই তারা এটা নিয়ে মাথাও তেমন ঘামায় না। তবে যারা দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষার জন্য যেতে চায়, তারা কিছুটা শূন্যতা অনুভব করে। স্বীকৃতি আদায়ের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল দেশের বাইরে পড়ালেখার পরিবেশকে আরো সুগম করা। কিন্তু দীর্ঘ এই সময় পরও তার কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। অবশ্য পড়বে বলেও মনে হয় না।
জামিয়া কারিমিয়া রামপুরার মুহাদ্দিস মুফতি আবুল ফাতাহ কাসেমি বলেন, ‘সনদের স্বীকৃতি পাওয়ার পর শুধু সামাজিকভাবে একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে ঠিক। আগে সনদের স্বীকৃতি না থাকার কারণে অনেকে কওমি মাদরাসায় পড়তে নিরুৎসাহিত হতো। কওমি শিক্ষার ভিত্তি নেই, এই কথা বলার এখন কোনো সুযোগ নেই। এর বাইরে কোনো লাভ হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।’
তার মতে, কওমি স্বীকৃতির সফলতার কথা যদি বলি তা ২০ পার্সেন্ট। এছাড়া ৮০ পার্সেন্টই ব্যর্থতা। এর জন্য আমি আমাদের নেতৃবৃন্দকেই দায়ী করবো। তারা যদি ভালোভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতো বা এখনো করে এই সনদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বেশকিছু সফলতা পাবে।
কী কী সুফল পাওয়া যেতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমেই আমাদের প্রাণের মারকাজ দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ার সুযোগ করা যাবে, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ধর্মীয় শিক্ষক হতে পারবে, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ধর্মীয় শিক্ষক হতে পারবে। এছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে।
উত্তরা জামিয়াতুদ দাওয়া আল ইসলামিয়ার সিনিয়র শিক্ষক মুফতি আলী হুসাইন বলেন, আসলে কওমি সনদের মাধ্যমে সরকারি কোনো চাকরিতে অংশগ্রহণ করতে পারব কি না কিংবা বাস্তবজীবনে কোন কোন কাজে আসবে তা কিন্তু লম্বা এই সময়েও পরিষ্কার হয়নি।
তিনি হতাশার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, সনদ প্রদানের সময় সরকারি-বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, দারুল উলুম দেওবন্দ, নদওয়া, দারুল উলুম করাচি, মদিনা ও আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহির্বিশ্বে উচ্চশিক্ষা অর্জনসহ অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর কোনো বাস্তবতা এখনো দেখিনি। সনদের স্বীকৃতির যথাযথ বাস্তবায়ন না হলে এই স্বীকৃতির আবেদন হারিয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল ‘কওমি মাদ্রাসার আলেমগণের সঙ্গে সাক্ষাৎকার’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এই স্বীকৃতির আইনি বৈধতা দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট এই আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ১০ সেপ্টেম্বর প্রথমবার তা সংসদে তোলা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে ‘আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীন ‘কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান বিল, ২০১৮’ পাস হয়।