|| তাসনিফ আবীদ ||
ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ কওমি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রাণকেন্দ্র। সেখানে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখে দেশের লাখো কওমি শিক্ষার্থী। কিন্তু পাকিস্তান-বাংলাদেশ বিভক্তির পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের দেওবন্দে পড়ার বিষয়টি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি হলেও নানা কারণে এ পথও বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। যার ফলে অবৈধ পথ পাড়ি দিয়েই তাদের ভারতে যেতে হয়। এর ফলে নানা সময়ে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় ভারতের সীমান্তরক্ষীদের হাতে গ্রেফতার হয় বাংলাদেশের কওমি শিক্ষার্থীদের অনেকে। পোহাতে হয় নানা দুর্ভোগ।
প্রাণের দেওবন্দে বৈধভাবে গিয়ে যেন পড়াশোনা করা যায়, সেজন্য কম কাঠখড় পোড়ায়নি কওমি সংশ্লিস্টরা! মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালন, প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি, সোশ্যাল মিডিয়ায় ইস্যু তৈরি, বোর্ডগুলোর দায়িত্বশীলদের সচেতন করা, অনলাইন-অফলাইনে আলোচনার পরও এ দাবি আদায় যেন সোনার হরিণ হয়েই রয়ে গেছে।
দারুল উলুম দেওবন্দে বর্তমানে পড়াশোনা করছেন দেশের একটি স্বনামধন্য কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী। সঙ্গত কারণে তিনি দেশে পড়াশোনা করা মাদরাসার নাম ও নিজের নাম প্রকাশ করতে আগ্রহী নন। তার কাছে দেওবন্দ যাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম।
তিনি বলেন, আসলে আমরা কয়েকজন একসঙ্গে এসেছি। যেই প্রক্রিয়াই এসেছি তা পাবলিকলি বলার মতো না। বললে আমরা যারা আছি বর্তমানে সবাই বিপদে পড়ে যাবো। অনেক ইচ্ছে ছিল বৈধভাবে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেওবন্দ পড়তে আসবো। কয়েক বছর চেষ্টা করার পরও পারিনি। আবার মনকেও মানাতে পারছিলাম না দেওবন্দের বরকত নেওয়া থেকে।
‘কেউ দারুল উলুম দেওবন্দে আসতে যতো বাধাবিপত্তিতে পড়তে হয়, আল আযহার কিংবা মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও কেউ এরকম বাধার মুখে পড়তে হয় না। দু’দেশের অসম্পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে স্টুডেন্ট ভিসায় কোন কওমি শিক্ষার্থী সরাসরি দেওবন্দ আসতে পারে না। দুঃখের কথা কাকে বলবো, আমরা দেওবন্দি আদর্শ ও সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানে পড়েও উচ্চশিক্ষার জন্য দেওবন্দে আসার যথাযথ সুযোগ থেকে বঞ্চিত।’ –বলেন তিনি
তার মতে, বাংলাদেশের কওমি শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে সবচেয়ে দেওবন্দেই বেশি আসতে চায়। এজন্য কওমি শিক্ষার্থীদের দেওবন্দসহ ভারতের অন্যসব মাদরাসায় পড়াশোনার সুযোগটা আরো সহজতর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের মৈত্রী দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দেওবন্দ পড়াশোনার প্রক্রিয়াটা সহজ করা সময়ের দাবি।
স্বাধীনতার এতো বছর পর এসেও স্বাধীনভাবে কওমি শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াশোনা বিশেষ করে দেওবন্দ পড়াশোনার বিষয়টি সহজ ও স্বাভাবিক না হওয়ায় ২০১৯ সালের মার্চে হাইয়াতুল উলয়ার অধিনে একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের একজন রাজধানীর আল জামিয়া আল ইসলামিয়া ইদারাতুল উলুম আফতাবনগর মাদরাসার প্রিন্সিপাল মুফতি মুহাম্মদ আলী। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কমিটিটি কোন প্রক্রিয়ায় কাজ করছে বর্তমানে?
তিনি বলেন, তৎকালীন সময়ে কমিটি গঠন করা হলেও নানা কারণে বর্তমানে সেই কমিটির কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। হাইয়াতুল উলয়ার সামনের মিটিংয়ে বিষয়টি উত্থাপন করবো যেন ছাত্রদের দেওবন্দে পড়ার বিষয়টি সহজ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজধানী মিরপুরের জামিয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদ মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও দারুল উলূম দেওবন্দের ফারেগ মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়ার সঙ্গে। তার মতে, বিষয়টি নিয়ে যতই আলাপ-আলোচনা হোক মূলত এটি সহজ হবে যদি বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম উলামা ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া কিংবা কওমি মাদরাগুলোর সম্মিলিত শিক্ষাবোর্ড আল হাইয়াতুল উলইয়ার মাধ্যমে দারুল উলূম দেওবন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। মূলত দারুল উলূম দেওবন্দ উদ্যোগ নিলেই এ দাবি আদায় সহজ হবে। ভারতের মাধ্যমে বিষয়টি উত্থাপিত হলে বাংলাদেশে সহজেই ভিসা পাওয়া যাবে।
কওমি ছাত্রদের স্বপ্ন সারথী হয়ে এসেছিল ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া।’ সরকারী সনদের মাধ্যমে দেওবন্দে পড়াশোনার সব জটিলতা কেটে যাবে এমনটাই আশা ছিল সবার। কিন্তু অর্ধ যুগ পাড় হলেও কওমি শিক্ষার্থীদের সুদিন এখনো আসেনি। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ুয়া একজন বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পড়াশোনার জন্য অনায়াসে যেতে পারে। আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও পৃথিবীর নানাপ্রান্তে পড়ছে। কিন্তু কওমি শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াশোনাতেই যত বাধা। অধরাই রয়ে যায় তাদের স্বপ্ন। শাদাকালো স্বপ্নগুলো আর রঙ্গিন হতে পারে না।