ধর্ম, পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় বিধিতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ি ইউনিয়নের যুবক রবিজুল ইসলাম (৩৮)-এর সাত বউ নিয়ে সুখের সংসার দাবিকে রীতিমতো সামাজিক শৃঙ্খলা লঙ্ঘন ও চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ অপরাধ মনে করছেন সমাজ বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা। সেই সাথে বৈধ কাবিন ছাড়া একসঙ্গে ৭ নারীর একত্রে অবস্থানের অন্তরালে প্রতারণা ও নারী পাচারসহ আরও কোনো অভিসন্ধি থাকতে পারে এমন সন্দেহে দ্রুত তদন্ত দাবিও করেন তারা। স্ত্রীদের অভিযোগ—অসহায়ত্বের সুযোগে পূর্ব স্ত্রীর সম্মতি না নিয়ে বা পরবর্তী স্ত্রীদের বিবাহের পূর্বে আগের স্ত্রী সম্পর্কিত তথ্য গোপন করে সবগুলো বিয়ে করেছেন রবিজুল। তবে অভিযুক্ত রবিজুলের দাবি, বিধিসম্মত বিবাহ না হলেও কারো কোনো অভিযোগ নেই বলেই একসাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থেকে সংসার করছেন তার সাত স্ত্রী।
সরজমিন অনুসন্ধানকালে জানা যায়, অভাব-অনটনের সুযোগে নানাভাবে ফুসলিয়ে, পূর্ব স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে, তথ্য গোপনসহ প্রতারণা করে সখ্য গড়ে তোলার মাধ্যমে এক এক করে সাত নারীকে বিয়ে করেছেন রবিজুল। বিয়ের পর যখন পূর্ববর্তী স্ত্রীদের সম্পর্কে জানতে পারেন তখন আর পেছন ফেরার পথ না পেয়ে অগত্যা মেনে নিয়েই স্বামীর বাড়িতে অবস্থান শুরু করেন। এভাবে চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর—এই চার মাসেই রবিজুল বিয়ে করেছেন ৪টি। বাবা-মায়ের অভাবী সংসারের মেয়ে হওয়ায় ও অসহায়ত্বের কারণে বাধ্য হয়ে তারা পড়ে আছেন এখানে।
কিশোরগঞ্জের মেয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী রুবিনা আক্তার (২৮)। ২০১২ সালে জীবন চালাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন লিবিয়ায়। সেখানেই টাইলস মিস্ত্রী রবিজুলের সাথে পরিচয় হয় রুবিনার। পরিচয়ের একপর্যায়ে খুব অল্প সময়েই সখ্য গড়ে ওঠে রবিজুল-রুবিনার। সখ্য থেকেই বিয়েও হয় দুজনের। রুবিনা জানান, ‘বিয়ের একসপ্তাহ পরই আমি জানতে পারি রবিজুলের বাড়িতে আগে থেকেই বউ বাচ্চা আছে’। বিষয়টি রবিজুলের কাছে জানতে চাইলে বলেছিল তাতে কোনো সমস্যা নেই। বউ আমাকে মেনে নেবে। যেহেতু আমি নিজেও পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলি সে কারণে আমিও আর প্রকৃত অবস্থাটা পরিবারকে না জানিয়েই এখানে সংসার করছি। আমার বাবা-মা এখনও জানে যে আমিই রবিজুলের বড় বউ’।
মিরপুর উপজেলার পোড়াদহের মেয়ে ষষ্ঠ স্ত্রী জুঁই আক্তার (২৩) বলেন, ‘গত দেড় মাস পূর্বে আমাকে রবিজুল বিয়ে করে। রবিজুলের সাথে আমার বিয়ে ছিল দ্বিতীয় বার। পূর্বের স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর প্রায় ৫ বছর দিনমজুর বাবার ঘরে মানবেতর জীবন ছিল আমার। এসময় আমার বাবা-মাকে রাজি করিয়ে রবিজুল আমাকে বিয়ে করে। তবে আমি জানতাম না যে রবিজুলের আগে আরও ৫টি বউ আছে। জানলে কি আর এই বিয়েতে আমি রাজি হতাম। তাছাড়া রবিজুলও তার পূর্ববর্তী ৫ বিয়ের কথা গোপন করেছিল। আমাকে বিয়ে করার ১৮ দিন পূর্বে একটা বিয়ে করেছে এবং আমাকে বিয়ের ১৮ দিন পর সর্বশেষ সপ্তম বিয়ে করেছে। এখন কি আর করা! এখানে পেটভরে দুমুঠো খাবার পাচ্ছি—এটা আমার জন্য অনেক’।
স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষিকা প্রতিবেশী সাবিনা খাতুন জানান, ‘হঠাৎ ইউটিউবে ভাইরাল হওয়া একটা সংবাদ দেখে আমি আশ্চর্য হলাম যে আমারই বাড়ির পাশে একসাথে সাত বউয়ের সংসার। এমন একটা ঘটনা আর আমি জানতেই পারিনি। তাই কৌতূহলবশত দেখতে এসেছিলাম। বউদের সাথে কথা বলে বুঝতে চেষ্টা করলাম যে ব্যাপারটা কি? কিভাবে সম্ভব নির্বিবাদে একসাথে ৭টি বউ সহাবস্থানে থেকে সংসার করে? ওদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে যে রবিজুল প্রত্যেক বউকেই বিয়ে করেছে তথ্য গোপন করে। এরা প্রায় সবাই গরিব ঘরের মেয়ে। সে কারণে তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়তো আপাতত একসাথে আছে। তবে সেটা কতদিন স্থায়ী হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়’।
রবিজুলের পিতা আইন উদ্দিন বলেন, ‘আইনে নাই, ধর্মেও নাই ৭ বিয়ে, একন ছেইলি বিয়ে কইরি ফেইলিচে, ইডা বৈদি না জানিউ মাইনি নিতি হচ্চে। ইছাড়া কিই বা করার আচে আমার?’। এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন—‘সুখ শান্তিতে বসবাস কল্লিই ভালো’।
আইন লঙ্ঘন করে বৈধ কাবিন ছাড়াই ৭ বিয়ের বিষয়টাকে স্বীকার করে রবিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ৭ বিয়ের মিশন কমপ্লিট। এইটা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে দেশবাসীর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী’। আমার বউদের যেহেতু কোনো অভাব অভিযোগ নেই। এজন্য আমার যে শাস্তি হয় হয় মেনে নেব’।
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এমন লাগামহীন বহু বিবাহ প্রথা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। অথচ এমন একটা ঘটনাকে প্রতিষ্ঠিত গণ ও সমাজমাধ্যমে ব্যাপক হাতে প্রচার করাটা কার্যত: সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে দেওয়ারই চেষ্টা বলে মনে করি। এ জাতীয় গর্হিত কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সামাজিক শৃঙ্খলার বিপর্যয় রুখতে দ্রুত বিষয়টির সুরাহা হওয়া দরকার’।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার উপপরিচালক নুরে সফুরা ফেরদৌস জানান, ‘এভাবে প্রকাশ্য বেআইনি কর্মকাণ্ড করা এবং এগুলোর সামাজিক প্রভাবের কথা না ভেবে ব্যাপক হারে প্রচার করাটাও একই অপরাধের শামিল। বৈধ কাবিন ছাড়া একজন ব্যক্তি ৭ নারীকে স্ত্রী দাবি করে প্রকৃত অর্থে তিনি আরও কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে লিপ্ত আছে কি না তা খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে’। তিনি আরও বলেন, ‘বৈধ-অবৈধ বা ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে এজাতীয় অপরাধকে উসকে দিয়ে সামাজিক বিপর্যয় ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট ঠেকাতে দরকার সকলেরই সামাজিক দায়বোধ ও সচেতনতা’।