জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হয়েছেন শায়খ মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী।
দলটির পক্ষ হতে জানানো হয়েছে, সাবেক সভাপতি শাইখুল হাদীস আল্লামা মনসুরুল হাসান রায়পুরী রহ. এর ইন্তিকালে দলীয় সংবিধান অনুযায়ী ও নীতিনির্ধারণী ফোরামের সর্বসম্মতিক্রমে আল্লামা আব্দুর রহীম ইসলামাবাদী দা:বা:-কে জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে।
কে এই মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী?
মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী একজন বিজ্ঞ আলেম, সচেতন ইতিহাসবিদ, চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ রাজনীতিক, আদর্শ শিক্ষক, গবেষক, আধ্যাত্মিক সাধক, লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক।
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম ইসলামাবাদী চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভার অন্তর্গত পূর্ব সুয়াবিল ভাঙ্গাদিঘীরপাড় গ্রামে ১৯৬৪ সালের ১৩ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী আরেছ মিয়া (রহ.), মাতার নাম নুরজাহান বেগম। দাদা হজরত মাওলানা আবদুস সাত্তার (রহ.) একজন বুজুর্গ আলেম ছিলেন। তিনি দেশের অন্যতম দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদরাসা, দিল্লীর বিখ্যাত আবদুর রব মাদরাসা ও দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষা লাভ করেন। হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) ও কতুবে আলম আল্লামা শাহ জমীরুদ্দীন সুয়াবিলী (রহ.) তার পীর ও মুরুব্বি ছিলেন।
মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী পূর্ব সুয়াবিল জমিরিয়া হোসাইনিয়া তাবলিগুল কোরআন মাদরাসায় প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষা লাভ করেন এবং ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক দক্ষিণ সুয়াবিল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি সমাপ্ত করেন। তিনি প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সময় ক্লাসে বরাবরই ১ম স্থান লাভ করতেন। পরে আল জামিয়াতুল আরাবিয়া নাছিরুল ইসলাম নাজিরহাট বড় মাদরাসায় কিছুদিন হেফজ পড়েন। পরবর্তীতে কিতাব বিভাগে ভর্তি হয়ে জামাতে উলা পর্যন্ত অধ্যায়ন করে হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন এবং এখান থেকেই ১৯৮২ সালে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে ‘মাওলানা’ সনদ লাভ করেন। পরে মুফতিয়ে আজম আল্লামা মুফতি আহমাদুল হক (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে কিছুদিন ফেকাহ, তাফসির ও তাসাউফ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন।
মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড থেকে দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল (হাদিস, তাফসির, ফেকাহ) পাশ করেন। তন্মধ্যে কামিল পাশ করেন (হাদিস) নাজিরহাট আহমদিয়া আলিয়া মাদরাসা এবং সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা থেকে ফিকাহ ও তাফসির বিষয়ে। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। চট্টগ্রাম কলেজে আইন বিষয়েও শিক্ষা অর্জন করেন। ঢাকার বখশি বাজারস্থ তিব্বিয়া কলেজ থেকে ইউনানী চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করে সনদ লাভ করেন।
মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী আমিরে শরিয়ত হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ও হজরত আল্লামা সৈয়দ আবুল হাসান আলী মিয়া নদভী (রহ.)-এর মুরিদ। চার তরিকার ইজাজতপ্রাপ্ত আধ্যাত্মিক এই সাধক সুলুক ও তাসাউফের মেহনতে খলিফায়ে মাদানি আল্লামা আবদুস সাত্তার শাহ (রহ.), মুফতিয়ে আজম আল্লামা মুফতি আহমাদুল হক (রহ.), শায়খুল হাদিস আল্লামা আবদুল আজিজ (রহ.) ও শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.), আল্লামা নোমান আহমদ রহ. সহ বেশ কয়েকজন বুজুর্গের খেলাফত পেয়েছেন।
সুদীর্ঘ ৪৩ বছর যাবৎ তিনি সাংবাদিকতা, গবেষণা ও সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ইসলামি বিশ্বকোষের একজন লেখক তিনি। এছাড়া দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়াবাংলা, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান, সাপ্তাহিক জমিয়ত, মাসিক মদীনা, মাসিক মুঈনুল ইসলাম, মাসিক আর রশীদ, মাসিক দাওয়াতুল হক, মাসিক দ্বীন দুনিয়া, মাসিক আত তাওহীদ, মাসিক আল হক, মাসিক অগ্রপথিক, মাসিক ফটিকছড়ি, মাসিক ফটিকছড়ি সংবাদ, সাপ্তাহিক তাকবীর, আওয়ার ইসলাম, ইনসাফ সহ অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় তার বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘মাসিক পয়গামে হক’-এর নির্বাহী সম্পাদক এবং ‘সাপ্তাহিক জমিয়ত’-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী (রহ.), বাবায়ে জমিয়ত মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী (রহ.), মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.), সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য মুফতী ওয়াক্কাস রহ. সহ অসংখ্য প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও লেখকের সান্নিধ্য পেয়েছেন। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
তার রচিত কয়েকটি বই হলো- ইসলাম ও বিশ্বশান্তি (অনুবাদ), হায়াতে মাওলানা হারুন বাবুনগরী, মাকামে সাহাবা (অনুবাদ), কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা, নারীদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, তারীখে ইসলাম, হায়াতে আতহার, হযরত হাফেজ্জী হুজুর ও তাঁর দ্বীনি দাওয়াত, আনোয়ারে সুলতান, সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ, আযীযুত্তালেবীন, মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব প্রতিক্রিয়া (অনুবাদ), ইসলামী জীবনব্যবস্থা, হযরত মাদানীর নির্বাচিত রচনাবলী, আলেম সমাজের ইতিহাস, নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার ইতিহাস, বোয়ালিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস ও মাওলানা তুরাব উদ্দীন রহ., ইসলামে রাষ্ট্র পরিচালনায় নারী, হযরত মাদানীর নির্বাচিত পত্রাবলী, বাংলাদেশে দেওবন্দ পদ্ধতির শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস, দারাখ কান্তা সেতারে (অনুবাদ), আদালত খান, খিলাফত আন্দোলন কি চায়, কেন চাই, কিভাবে চাই- ইত্যাদি। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য জীবনী, সমসাময়িক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন।
২০০৭ সালে মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী নিজ এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষের উৎসাহ, আবদার ও সাহায্য-সহযোগিতায় এবং শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী (রহ.)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব সুয়াবিল তালিমুল ইসলাম বালিকা (দাওরায়ে হাদিস, টাইটেল/দাখিল) মাদরাসা। বর্তমানে তিনি মাদ্রাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করছেন।
মাদরাসার সঙ্গে মাদানি মসজিদ ও খানকাহে এমদাদিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতি সোমবার খানকায় ইসলাহি মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী ইবনে বতুতা ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন। তিনি ইসলামি রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী। খেলাফত আন্দোলন দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৮৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম- ২ ফটিকছড়ি আসন থেকে এবং ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম সদর আসন থেকে বটগাছ প্রতীকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন।
১৯৯১ সনে মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী শতাব্দীর প্রাচীনতম সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশে যোগদান করেন৷ সাপ্তাহিক জমিয়ত পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, পরে সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য মুফতী ওয়াক্কাস রহ. এর রাজনৈতিক উপদেষ্টা নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক, সহকারী মহাসচিব, সহ সভাপতি, সিনিয়র সহ সভাপতি এবং নির্বাহী সভাপতি নির্বাচিত হন৷
গত ২২ নভেম্বর ২৪ ইংরেজি জমিয়তের সভাপতি আল্লামা মনছুরুল হাসান রায়পুরী র. এর ইন্তিকাল করলে দলীয় সংবিধান অনুযায়ী ও নীতিনির্ধারণী ফোরামের সর্বসম্মতিক্রমে আল্লামা আব্দুর রহীম ইসলামাবাদী দা:বা:-কে জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।