
সুখময় দাম্পত্য জীবনের জন্য স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। এ সম্পর্কে প্রিয় নবীজি (সা.) সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম, আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের নিকট সর্বোত্তম ব্যক্তি। কুরআন-হাদিসের আলোকে সুখময় দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে লিখেছেন- মুফতি ইবরাহীম আল খলীল।
পরস্পরে সহযোগিতা
প্রিয় নবীজি (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন দায়-দায়িত্ব পালন করার পরও স্ত্রীদের কাজে সহায়তা করতেন। তাদের ঘরের অনেক কাজ করে দিতেন। হজরত আসওয়াদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি আয়েশা (রা.)কে জিজ্ঞেস করলাম, নবীজি (সা.) ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন? তিনি বললেন, ঘরের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারবর্গের (কাজে) সহায়তা করতেন। আর নামাজের সময় হলে নামাজের জন্য চলে যেতেন। (বুখারি, হাদিস ৬৭৬।)
প্রশংসা করা
ইসলাম কিছু ক্ষেত্রে কিছু মানুষের প্রশংসা করতে উৎসাহ দিয়েছে। কারণ প্রশংসা মানুষের মনে আনন্দ দেয়। নিজ স্ত্রীদের প্রশংসা করার কথা ইসলাম বলেছে। যা প্রিয় নবীজি (সা.) করে দেখিয়ে গেছেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, পুরুষের মধ্যে অনেকেই পূর্ণতা অর্জন করেছেন। কিন্তু নারীদের মধ্যে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া এবং ইমরানের কন্যা মারইয়াম ছাড়া আর কেউ পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়নি। তবে আয়েশার মর্যাদা সব নারীর ওপর এমন, যেমন সারীদের (গোশতের সুরুয়ায় ভিজা রুটির) মর্যাদা সব ধরনের খাদ্যের ওপর। (বুখারি, হাদিস ৩৪১১।)
পরিবারে সময় দেওয়া
স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়া এবং মানসিক সাপোর্ট দেওয়া আদর্শ স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রী-সন্তানদের হক যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। সংযমী হতে হবে কথাবার্তায়। সাহাবি উকবা ইবনে আমের (রা.) বলেন, আমি একদিন রাসূল (সা.)-এর কাছে উভয় জাহানের মুক্তির পথ কী জানতে চাইলাম। উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, কথাবার্তায় সংযমী হও, পরিবারের সঙ্গে তোমার অবস্থান যেন দীর্ঘ হয় এবং নিজের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হও। (তিরমিযি, হাদিস ২৪০৬।)
মুখে খাবার তুলে খাওয়া
স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেওয়া সুন্নত। তেমনিভাবে স্ত্রীর মুখের খাবার খাওয়াও সুন্নত। এ বিষয়ে মুসলিম শরিফের হাদিসে বর্ণনা এসেছে। ‘শ্রেষ্ঠ সাদকা হলো, একজন মানুষ তার স্ত্রীর মুখে এক লোকমা খাবার তুলে দেবে।’ হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবীজি (সা.) আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি হায়েজের অবস্থায় ছিলাম। (বুখারি-২৯৭।)
সুন্দর নামে ডাকা
স্ত্রীকে সুন্দর নামে ডাকা সুন্নত। পারস্পরিক ভালোবাসা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধির জন্য স্ত্রীকে সুন্দর ও ভালোবাসাপূর্ণ নামে ডাকা উত্তম। এতে দাম্পত্য জীবনে সুখ ও শান্তি বজায় থাকে। নবীজি (সা.) তাঁর স্ত্রীদের বিভিন্ন সুন্দর নামে ডাকতেন, যা স্ত্রীদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন ছিল। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ভালোবেসে কখনো কখনো আমার নাম হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৪৭৪।)
একসঙ্গে খেলাধুলা করা
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি এক সফরে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেন, আমি তাঁর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করে তাঁর আগে চলে গেলাম। এরপর আমি মোটা হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আবারও দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম, এবার তিনি আমাকে পেছনে ফেলে দিলেন, বিজয়ী হলেন। তিনি বলেন, এ বিজয় সেই বিজয়ের বদলা।’ (আবু দাউদ ২৫৭৮।)
প্রেম-ভালোবাসা
নবীজি (সা.)-এর পবিত্র দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীদের সঙ্গে আন্তরিকতা ও রোমান্টিকতার এত সব চিত্র অঙ্কিত রয়েছে, যা একটি আদর্শ দাম্পত্য জীবনের উৎকৃষ্ট উপমা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পরবর্তী সময়ে উম্মুল মুমিনিনরা এসব ঘটনার বিবরণ এতটা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দিয়েছেন, যা তাদের ভেতরকার ভাব-আবেগের সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, পাত্রের যে অংশে আমি মুখ রেখে পানি পান করতাম তিনি সেখানেই মুখ লাগিয়ে পানি পান করা পছন্দ করতেন। (মুসলিম, হাদিস ৩০০।) হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি হায়েজ (ঋতুবতী) অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর মাথা আঁচড়ে দিতাম। (বুখারি, হদিস ২৯৫।)
একই মেসওয়াকে দাঁত মাজা
স্ত্রীর ব্যবহার করা মেসওয়াক দিয়ে মেসওয়াক করা সুন্নত। রাসূল (সা.) যখন মৃত্যুসজ্জায়, তখন রাসূল (সা.) আয়েশা (রা.)-এর কোলে শুয়ে ছিলেন এবং রাসূল (সা.) বারবার মেসওয়াকের দিকে তাকাচ্ছিলেন, কিন্তু রাসূল (সা.) এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে, মেসওয়াক চিবোতে পারবেন না, তাই আয়েশা (রা.) মেসওয়াক চিবিয়ে দেন এবং রাসূল (সা.) ওই মেসওয়াক দিয়ে মেসওয়াক করেন। হাদিসে এভাবে লালা একত্রিত হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে (বুখারি, হাদিস ৫২২৬।)
ঘুরতে যাওয়া
স্ত্রীদের সফরে নিয়ে যেতে রাসূল (সা.) লটারি করতেন, যার নাম আসত তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন, (বুখারি, হাদিস ২৫৯৩।)
চুমু দেওয়া
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) তাঁর এক স্ত্রীকে চুমা দিলেন, এরপর নামাজ আদায়ের জন্য বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু ওজু করেননি। আমি (উরওয়াহ) বললাম, আপনেই সেই ব্যক্তি। এতে তিনি আয়েশা (রা.) হাসলেন। (ইবনে মাজাহ, হদিস ৫০২।)
একই পাত্রে পান করা
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি ঋতুবতী অবস্থায় পানি পান করতাম এবং পরে নবীজি (সা.)কে অবশিষ্টটুকু প্রদান করলে আমি যেখানে মুখ লাগিয়ে পান করতাম তিনিও পাত্রের সে স্থানে মুখ লাগিয়ে পান করতেন। আবার আমি ঋতুবতী অবস্থায় হাড় খেয়ে তা নবীজি (সা.)কে দিলে আমি যেখানে মুখ লাগিয়েছিলাম তিনি সেখানে মুখ লাগিয়ে খেতেন। (মুসলিম, হাদিস ৫৭৯।)
মারধর না করা
হজরত আবদুল্লাহ্ ইব্নু যাম’আহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, তোমরা কেউ নিজ স্ত্রীদের গোলামের মতো প্রহার করো না। কেননা, দিনের শেষে তার সঙ্গে তো মিলিত হবে। (বুখারি, হাদিস ৫২০৪।)
পরিপাটি থাকা
স্ত্রীর সামনে নিজেকে পরিপাটি রাখা আদর্শ স্বামীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি স্ত্রীর অধিকার। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, আমি আমার স্ত্রীর জন্য পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি, যেমন আমিও চাই স্ত্রী আমার জন্য সাজুক। (বায়হাকি, হাদিস ১৪৭২৮।)