আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির বেড়াজালে বিপাকে পড়েছেন কতিপয় ইসলামী দলের প্রার্থীরা। আসন ভাগাভাগি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবশেষে জাতীয় পার্টির সঙ্গে ২৬টি আসনে সমঝোতা করেছে। এ ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ১৪ দলের শরীকদের সর্বশেষ ৬টি আসনে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সর্বমোট ৩২টি আসন ছাড় দিয়ে আওয়ামী লীগ সারাদেশে ২৬৩টি সংসদীয় আসনে নৌকা প্রতীকে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। জাতীয় পার্টি (জাপা) ২৮৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছে। ইসির রিটার্নিং কর্মকর্তারা গতকাল সোমবার বিভিন্ন দলের প্রতীক বরাদ্দ করেছে।
আজ মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে নির্বাচনী প্রচারনা শুরু হয়ে আগামী ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত চলবে। বিএনপি,জামাত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষায় এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত রয়েছে। শত শত বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ও আলেম ওলামারা কারাবন্দি। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাশীল হয়ে বুকভরা আশা নিয়ে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে কোনো আসন পাওয়ার আশ্বাস ভাগ্যে যুটেনি নির্বাচনে অংশ নেয়া ইসলামী দলগুলোর। নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগেই বেশ কিছু ইসলামী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেছিলেন। গত মাসের শেষের দিকে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর আল্লামা আতাউল্লাহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে ৯টি ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর আল্লামা আতাউল্লাহর নেতৃবৃন্দ ১৩ প্রার্থী বটগাছ মার্কা নিয়ে নির্বাচনে মনোনয়পত্র দালিখ করলে গাইবান্দা -১ আসনের প্রার্থী হাফিজুর রহমান ও পিরোজপুর-৩ আসনের প্রার্থী আব্দুল লতিফ সিরাজীল প্রার্থীতা বাতিল হয়ে যায়। দলের আমীর আল্লামা আতাউল্লাহ মুন্সিগঞ্জ-১ (শ্রীনগর-সিরাজদিখান) আসনে বটগাছ মার্কায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত রয়েছেন। দলের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বি-বাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বটগাছ মার্কা নিয়ে দলের সর্বমোট ১১ জন প্রার্থী নির্বাচনে লড়ছে। প্রার্থী মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে আসন ভাগাভাগির বৈঠকে আমরা কোনো প্রতিশ্রুতি না পেলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরা বিজয়ী হবো ইনশাআল্লাহ।
গত ৫ ডিসেম্বর রাতে জকিগঞ্জ উপজেলার আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী (রহ.) ফুলতলীর পীরের ছেলে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। এর পর থেকে তাঁদের সাক্ষাতের সংবাদ ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। বৈঠকের পর থেকেই হুছামুদ্দীনের নির্বাচনী এলাকায় তার অনুসারীরা বিষয়টিকে ‘শুভ ইঙ্গিত’ বলে প্রচার শুরু করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীকে নিয়ে গোটা নির্বাচনী এলাকায় নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সিলেট-৫ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মাসুক উদ্দিন আহমদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হুছামুদ্দীন চৌধুরী ছাড়াও আরও পাঁচজন প্রার্থী আছেন। তারা হলেন, জাতীয় পার্টির শাব্বীর আহমদ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের (বিএমএল) মো. খায়রুল ইসলাম, তৃণমূল বিএনপির কুতুব উদ্দীন আহমদ শিকদার, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. বদরুল আলম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আহমদ আল কবির।
উল্লেখ্য, জকিগঞ্জ-কানাইঘাট বরাবরই ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও আলেম উলামাদের পুণ্যভূমি। এই আসন থেকে এর আগে মাওলানা মুশাহিদ বায়মপুরী (রহ), মাওলানা ওবায়দুল হক উজিরপুরী (রহ) ও মাওলনা ফরীদউদ্দীন চৌধুরী সংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ইসলামী ঐক্যজোটের (সরকার সমর্থিত) চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনীর নেতৃত্বে দ্বাদশ নির্বাচনে ৪১জন প্রার্থী মিনার মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। দলের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী পিতা মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নির্বাচনী আসন বি-বাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) থেকে মিনার মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। আওয়ামী লীগ এ আসনটির দলীয় প্রার্থী শাহজাহান সাজুকে বসিয়ে জাতীয় পার্টির আব্দুল হামিদকে ছেড়ে দিয়েছে। ইসলামী ঐক্যজোটের শীর্ষ নেতা কুমিল্লা-২ (হোমনা-মেঘনা) প্রার্থী মাওলানা আলতাফ হোসেন বলেন, ইসলামী ঐক্যজোট আসন ভাগাভাগিতে কোনো প্রতিশ্রুতি না পেলেও আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায় থেকে বি-বাড়িয়-২ ও কুমিল্লা-২ আসনে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থীদ্বয়ের প্রতি সুভ ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এম এ মতিনের নেতৃত্বে মোমবাতি মার্কায় সারাদেশে ৩৮ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। দলের চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। দলের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগের সাথে আসন ভাগাভাগির দরকষাকষিতে কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের নির্বাচনী সমন্বয়কারী এইচ এম মুজিবুল হক শাকুর জানান, ইসলামিক ফ্রন্টের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মুজাদ্দেদীর নেতৃত্বে দলের ৪০ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের সাথে লড়বে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মুজাদ্দেদী।
নির্বাচনে কোনো আসন ভাগাভাগিতে ইসলামিক ফ্রন্ট বিশ্বাস করে না এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এ দলটির ২০ জন প্রার্থী বিজয়ের মালা ছিনিয়ে আনবে বলে সমন্বয়কারী দাবি করেন। জাকের পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার গতকাল ইনকিলাবকে বলেন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আমরা আছি। আমরা পুরোপুরি নির্বাচন বর্জন করিনি। সারাদেশে দলের মনোনীত প্রায় দুই শত প্রার্থীর মধ্যে ১৮টি নির্বাচনী আসনে দলীয় প্রার্থীরা গোলাপ ফুল মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। দলের মহাসচিব শামীম হায়দার বলেন, দলের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র উঠাননি। তিনি বলেন, আমি মুন্সিগঞ্জ-৩(মুন্সিগঞ্জ-গজারিয়া) আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলাম। গতকাল আমি প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছি। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নেতা সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) থেকে তৃণমূল বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের পর পর তাকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম থেকে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে দল থেকে তার পদ স্থগিত করা হয়েছে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে নৌকা প্রতীক দেয়া হয়নি। তার পরিবর্তে এ আসনে তার ভাতিজা বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টির চেয়ারম্যান শাহাজাদা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। নৌকা প্রতীক না দেওয়ায় বেশক্ষুব্ধ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আমার প্রতি অন্যায়, অবিচার করা হয়েছে। নৌকা দিলে দেবে, না দিলে নাই। আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই।
তিনি আরও বলেন, এতো বছর ধরে এক সঙ্গে ছিলাম। নৌকার পক্ষে ছিলাম। এখন তারা (আওয়ামী লীগ) যদি আমার আত্মীয়কে পছন্দ করে করুক। তারা বলছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। মাঠের রাজনীতি কিংবা জনসমর্থনের প্রশ্নে ছোট দল হলেও মামলার রাজনীতিতে ‘ঝানু’ খেলোয়াড় তরিকত ফেডারেশন। দলটির চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। ১৪ দলের শরিক হিসেবে নৌকা প্রতীকে চট্টগ্রাম-২ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন টানা দু’বার। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ তাকে আসন না দেয়ায় নাখোশ তিনি। তিনি বলেন, আমি চারবারের এমপি। তাই না জেতার মানুষকে আসন দেয়া হবে না- আমার বেলায় সে কথা প্রযোজ্য না। মন্ত্রী হবার জন্যে দর কষাকষি করতে পারতাম এর আগেও, বা উচিত ছিল আমার। কিন্তু করা হয়নি। নজিবুল বশর আরও বলেন, আমি এক কথা বলাতে, বলছে হচ্ছে না বা মূল্যায়ন হয়নি। আজকে হয়নি, এর আগেও মূল্যায়ন হয়নি। কোন বিবেচনায়, কেন পেলাম না- সেটা বলবো না। তরীকত ফেডারেশনের দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।