বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সারা বছরের লালিত একটি আকাঙ্খা। একগুচ্ছ স্বপ্নের বাস্তবায়ন। মনের ভেতর জমিয়ে রাখা অনেক গল্পের সমারোহ। বছরঘুরে হাজির হয় কাঙ্খিত সেই দিনটি। মাদ্রাসার ছোট শিশুটি থেকে নিয়ে বড় হুজুর পর্যন্ত সকলেই এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে। কলেজ- ভার্সিটিতে আছে যেমন নবীন -বরণ উৎসব, স্পোর্টস, বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মাদ্রাসাতে তেমন কিছু নেই। শুধু বছরান্তে ঐ একবার ওয়াজ মাহফিলই তাদের সব। আর এই উপলক্ষ্যে ছাত্রদের দস্তারবন্দী, বার্ষিক পুরস্কার বিতরণ, হামদ- নাত, ক্বেরাত প্রতিযোগিতা পরিশেষে বিজয়ীদের হাতে পুরষ্কার। মোটকথা মাদ্রাসার ওয়াজ মাহফি্লের দিনটি সবার জন্য উৎসবমুখরতার চূড়ান্ত একটি দিন।
তাছাড়া ওয়াজ মাহফিল তো আল্লাহর জন্য। মানুষের হেদায়েত, নিজের ফায়দা , দিশেহারা জাতির হেদায়েতের পথ নির্দেশের বানী গুঞ্জরিত হয় মাহফিলের মঞ্চ থেকে। স্হানীয় ওলামায়েকেরাম কমবেশী ওয়াজ নসীহত করে থাকেন। এলাকার মসজিদ এবং মহল্লাতে তাদের বয়ান সারাবছর জুড়ে চলে। এরপরেও এলাকার মানুষের ব্যাপক ফায়দার জন্য দূরের আলেমদের দাওয়াত করে আনা হয়। হয়ত কোন বড় ওয়ায়েজ, মাদ্রাসার শাইখুল হাদীস, মোহতামিম কিংবা যার দেশ ও দশের মাঝে খ্যাতি রয়েছে, সেধরনের বিশেষ ব্যক্তিদেরকেই দাওয়াত করে আনা হয়।
বড় পরিতাপের বিষয় হল, আজকাল আমন্ত্রিত অধিকাংশ ওয়ায়েজ বা বক্তা তাদের চোয়ালের ব্রেক হারিয়ে ফেলেছেন। মুখের লাগাম খুলে যথেচ্ছা বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। কিছু বক্তা তো মাহফিলের মঞ্চকে দাম্ভিকতা আর নিন্দা চর্চার আসর বানিয়েছেন। বয়সে ছোট কিন্তু কথা থেকে দম্ভ চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। যেসব কথা বল তার জন্য সাজে না সেসব কথা অবলীলায় বলে ফেলেন। যার দরুণ সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা ও মারাত্মক ফিতনা।
অনেক জায়গায় বক্তা মঞ্চে উঠে এমন গরম রাজনৈতিক বক্তৃতা ঝারেন যার কারণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং প্রশাসণ ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে। বক্তা সাহেব তো গরম বক্তৃতা করে টাকার বান্ডেল নিয়ে স্হান ত্যাগ করেন এরপর যত চাপ সৃষ্টি হয় মাহফিল এন্তেজামিয়া কমিটি তথা মাদ্রাসার সাধারণ হুজুরদের উপরে। বক্তারা স্হান- কাল সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না হয়ে সরাসরি প্রতিপক্ষকে আঘাত করে কথা বলেন। কখনো সরাসরি ক্ষমতাসিন দলকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু পরক্ষণে ঝামেলা পোহাতে হয় কর্তৃপক্ষের। এবং পরিশেষে ওয়াজ মাহফিলের দরজা ভবিষ্যতের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
বেশ কয়েকবছর যাবত ওয়াজের ময়দানে এমন বাগাড়ম্বরতা চলছে। মুহুর্মুহু সাউন্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ফলে তা আর ওয়াজ থাকছে না, তা হয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চ। এসমস্ত লাগামহীন উস্কানিমূলক ওয়াজের কারণে বহু সংখ্যক বক্তার উপর প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি হয়েছিলো। অনেকেই কারাবরণ করেছিলেন।
তবে মাঝখানে বছরদুয়েক কাশিমপুর ও কেরানিগঞ্জের নতুন ভবনগুলোর কল্যাণে এদিকের পরিবেশ কিছুটা শান্ত ছিল। লাল ভবনগুলো থেকে বক্তারা ছাড়া পাওয়ার পর আবার শুরু হয়েছে প্রলাপ। সেই লাগামহীন উদ্ভট বক্তব্য, পরনিন্দা , বাগাড়ম্বরতা, আক্রামানাত্মক কথা, সরকার বিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য ইত্যাদি কারণে এখন ওয়াজ মাহফিলগুলো বন্ধের উপক্রম হয়ে পড়েছে।
এরদ্বারা ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে মাদরাসাগুলো। ছাত্র শিক্ষকগণের মন ভেঙে যাচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠানের ওয়াজ মাহফিল বন্ধ হওয়া মানেই সে মাদ্রাসার শত শত শিক্ষার্থীর অন্তর ফেটে চৌচির হওয়া। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের আর্থিক এবং সামাজিক মর্যাদাও ক্ষুন্ন হচ্ছেই।
ইদানিং ওয়ায়েজীনদের আরেক নতুন খাছলাত আবিস্কার হয়েছে যার নাম ‘রেষারেষি’। একে অপরের পিছনে লাগা। কিছু বক্তা তো আছে, সারাবছরই তার বক্তব্যে অন্যের সমালোচনা প্রাধান্য পায়। সম্পূর্ণ হিংসাবশত এমন বক্তব্য দিয়ে থাকেন তারা। অথচ যাদের বিরুদ্ধে তিনি বক্তব্য দেন তা একটি হক্কানী কাফেলা। তবুও তার বিরুদ্ধে লেগে থাকেন। যেটা খুবই নিন্দনীয়।
মাথায় কালো পাগড়ি, গায়ে বিশাল লম্বা কুর্তা, দেখতে জমানার কুতুব মনে হয়। কিন্তু তার মুখ থেকে হক্কানী জামাত নিরাপদ নয়। এভাবে মাঠে ময়দানে একশ্রেণীর ওয়ায়েজদের রেষারেষি চরম পর্যায়ে। একে অপরের পিছে লেগে থাকা যেন তাদের দৈনন্দিন অজিফা।
মোটকথা, ওয়ায়েজীনদের বাড়াবাড়ি বন্ধ না হলে জাতি ভ্রষ্টতার আরো অতলগহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে। সাধারণ মানুষ অনেক আশা- ভরসা নিয়ে ওয়াজ শুনতে যায়। কিন্তু সেখানো ওয়াজ শোনার পরিবর্তে যদি বক্তাদের পরনিন্দা শুনতে হয় তাহলে তো আম- জনতার কোন উপকার হবে না। নিরর্থক হয়ে যাবে সবকিছু।
আল্লাহ আমাদের উপর রহম করুন। আমিন।
লেখক, শিক্ষক ও বিশ্লেষক