আরাফাত নুর :
বাবা নামক বটবৃক্ষটা নেই। আজ চার বছর পূর্ণ হতে চললো। যার ছায়ায় আদর ভালোবাসা আর কায়ায় বড় হয়েছি। মানুষের মতো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানিনা। তবে বাবা সব সময়-ই চাইতেন আমরা যেনো মানুষের মতো মানুষ হই। শিক্ষা দীক্ষা চাল-চলন ও কথা বলার ধরণে সবার মন জয়ী। তাইতো শতো কষ্ট আর সংসারের টানাপোড়েনের মাঝেও বাবা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। বাবা প্রায় সময় বলতেন, “মানুষ মরে যায় তবে তাঁর গুণগান ও কৃতিত্ব এই পৃথিবীতে রয়ে যায়। সুতরাং মানুষের মতো মানুষ হও। পৃথিবী আজন্ম তোমাদের মনে রাখবে।সম্মান করবে”।
বাবা এতো দ্রুত চলে যাবেন জানা ছিলোনা। বাবা চলে গেলেন, তবে চিনিয়ে গেলেন আমাদের, পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষ নামক কিটগুলোকে। তারা যে কতটা ভয়ঙ্কর, স্বার্থান্বেষী ও স্বার্থপর। তাইতো বাবার মৃত্যুর এই এক বছরে কত ঝড়-তুফান ঘুর্ণিঝড় আর দুর্বিপাকের সম্মুখীন হয়েছি আমি এবং আমার পরিবার তার হিসেব কারও জানা নেই।
এই পৃথিবী আর পৃথিবীর পাষাণ মানুষগুলো কত নিষ্ঠুর তা বুঝতে পেরেছিলাম বাবার মৃত্যুর পর। তাইতো বাবাকে দাফনের তৃতীয় দিনের মাথায় আমি ঢাকায় চলে আসি। বাড়িতে থাকিনি।থাকতে পারিনি। তবে নিরবে শতো কষ্ট সয়ে গেছেন পরিবার। কাউকে বুঝতেও দেননি। বাবার মৃত্যুটা ছিলো করোনাকালীন স্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু পাড়াপ্রতিবেশি ও আত্মীয় সজনদের চোখে মুখে ছিলো হতাশার ছাপ। মনে অজানা আতঙ্ক ও ভয়। যদি করোনায় মারা গিয়ে থাকে! এই ভয় থেকেই তারা আমাদের থেকে দূরে থাকতো, পাশের বাড়ির বাচ্চা ছেলেটাকেও আমাদের বাসায় আসতে নিষেধ করতো! আমাদের পরিবারের লোকজনকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেও বাধা দিতো।
বাবার মৃত্যুর প্রথম দিনের দৃশ্যটা আজও আমার চোখে স্পষ্ট ভেসে ওঠছে। আমি কাঁদছি। ভাইয়া কাদঁছে। পরিবারের সবাই মাটিতে গড়াগড়ি করছে। আম্মা একটু পরপর সেন্স হারাচ্ছেন কিন্তু আম্মার মাথায় পানি ঢালার মতো কেউ নেই! আমার বোনটাই কাঁদছে আর আম্মাকে নিয়েও দৌঁড়াচ্ছে। মাথায় পানি ঢালছে!
মনে পড়ে, বাবাকে যখন শেষ বারের মতো ঘর থেকে বের করেছিলাম তখন আপন কাউকেই কাছে পাইনি, পেয়েছিলাম ভাইয়ার দু’জন বন্ধুকে। তারাই মৃত বাবার শক্ত দেহটাকে কোলে করে বাহিরে এনেছিলো। গোসলের ব্যবস্থা করেছিলো। গোসল দিয়েছিলাম আমি,সাথে ছিলো মসজিদের ইমাম। সে ইমামের চাকরিটাও খেয়ে দিতে চেয়েছিলো আমাদের সমাজের কিছু হায়েনা। অপরাধ আমার মৃত বাবার গোসলে তিনি কেন শরীক ছিলেন! এখন যদি করোনা ছড়িয়ে পড়ে, সে ভয়ে। তাই তাকে কয়েকদিনের ছুটিতেও পাঠিয়েছিলো সমাজ অধিপতিরা।
তবে আলহামদুলিল্লাহ! বাবার দেয়া শিক্ষানুযায়ী,গোসল কাফন-দাফন ও কবরে নামানো পর্যন্ত প্রতিটা কাজ-ই করেছিলাম আমরা তিন ভাই কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে। তবে কিছু প্রিয় ও আপন মানুষ পাশে পেয়েছিলাম বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিলো। আল্লাহ সকলকে তাদের প্রতিদান বুঝিয়ে দিন, আর বাবাকেও জান্নাতের সু-উচ্চ মাকাম দান করুন।(আমিন)