একদিন শব্দ ছক করতে করতে জেনে গেলাম – ‘বাবা’ আসলে একটা এক শব্দের ধাঁধা, যে আমাকে মাঝে রেখে সবদিক থেকেই সমানভাবে ঘিরে আছে। আর আমি শুধুই এদিক-ওদিক ঘুরে কাছে যেতে চাইছি। আসলে বাবাকে নিয়ে সন্তানের অনুভূতিগুলো সবসময়ই মনের গহীনে চাপা পড়ে থাকে। বাবার ত্যাগ, তিতিক্ষা, স্নেহ, ভালোবাসা, রাগ প্রতিটি সন্তান আগলে রাখে তার বুকের এক কোণে। কখনো মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠেনা, বাবা ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি তোমায় বাবা। বাবাকে আমরা আব্বা, আব্বু, বাবা যে নামেই ডাকিনা কেন, সব বাবা’ই তার সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করেন। তাদের বাহ্যিক রূপ ভিন্ন হলেও অন্তস্থ রূপ একই চিহ্ন বহন করে।
বাবা এক নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস। আমাদের যত অভিযোগ- অভাব, সুখ- আহ্লাদ, তার বেশিরভাগই বাবার কাছে। সব ধরনের বিপদে – আপদে তিনিই আমাদের আগে আগলে রাখেন, সামলে রাখেন। তিনিই সন্তানের সঠিক পথপ্রদর্শক। তার হাত ধরেই আমাদের চেনা হই এই পৃথিবীটাকে। যেকোনো মানুষের প্রথম ও সত্যিকারের বন্ধু বাবা। এটা অন্তত আমার ক্ষেত্রে। বাবা আসলে নির্ভরতার প্রতীক। বলা না হলেও তিনিই আমার মহানায়ক, আমার সুপারহিরো। মাঝেমাঝে বাবাকে ম্যাজিশিয়ানও মনে হয়, যিনি হাসিমুখে সন্তানের সব চাওয়াকেই পাওয়াতে পরিণত করেন। চারপাশে আমরা অনেক গম্ভীর বাবাকেও দেখি, যারা একটু রাশভারী প্রকৃতির হয়ে থাকেন। কিন্তু দিনশেষে সব বাবাই শুধু ভালোবাসতেই জানেন। যারা বাবা হয়েছেন তারাও পিতৃত্বের স্বাদ পেয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেন নতুন এক ভিন্ন রূপে। সন্তানদেরকে নিয়েও তাদের হৃদয়ের অন্তরালে থাকে এক বিশাল না বলা অনুভূতি।
বাবা হলেন বন্ধুর মতো। বাবা মানেই মাথার উপর বিশাল ছায়ার মতো বটবৃক্ষ। সবচেয়ে বড় সাপোর্ট। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে আগলে রাখেন আমাদের, ছায়ার মতো পাশে থাকেন, নির্ভরতা দেন। নিজের হাজারও সমস্যা চাপা রেখেও তিনি সন্তানদের সুরক্ষিত রাখেন। সন্তানের ভালোর জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে দুবারও ভাবেন না বাবা। বাবা এক আপাত গম্ভীর খোলসের আড়ালে থাকা লুকায়িত সেই কোমল রূপ। বাবাদের কাঁধ বোধহয় অনেকটা চওড়া হয়, না হলে তাতে সংসারের এত ভারী বোঝা কী করে বহন করেন! অনেক বাবা একটু ভারী স্বভাবের হয়ে থাকেন, কিন্তু তার আড়ালে উঁকি দিলেই দেখা মেলে এক বিশাল বড় ত্যাগের পাহাড়। তারা নিজের কষ্টের কথা সন্তানের থেকে আড়াল করে রাখেন। তাই হয়তো কোনো এক অদৃশ্য দেয়ালে ঢাকা পড়ে বাবার ভালোবাসার গভীরতা।
বাবা একাই একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর ছায়ায়, তাঁর সংস্পর্শে প্রতিটি সন্তান কোন প্রকার বাঁধা- বিপত্তি ছাড়াই পরম মমতার পরশে বেড়ে উঠতে থাকে। তাঁর শক্ত হাত ধরেই সন্তানেরা সকল প্রকার বাঁধাকে দূরে ঠেলে দেয়। প্রতিটি সন্তানের জীবন গঠিত হয় বাবার শ্রমে আর ঘামে। সন্তানকে আগলে রাখতে গিয়ে বাবা শুধু নিজের সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যই নই কখনো বা বিলিয়ে দেন তাঁর জীবন।
বাবা মানেই সীমাহীন এক আস্থার সাগর। ঝড়-ঝঞ্ঝাটে নির্ভরতা, শক্ত খুঁটির ঘর। এই দুই অক্ষরের শব্দটি যিনি ধারণ করেন তার কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা গন্ডি নেই। বাবাদের থেকেই সন্তানেরা শিখে যে জীবনকে সহজভাবে নিলেই জীবন সহজ, আর যদি কঠিনভাবে নেয় তবে জীবন কঠিন। একজন সন্তানের ভবিষ্যৎের সকল সম্ভাবনাগুলোকে তিল তিল করে তৈরি করে তোলেন একজন বাবাই। এই পৃথিবীতে একজন সন্তানের জীবনের ভালোবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করে তার বাবার মাধ্যমে। একজন বাবাই তাঁর সন্তানকে হাতে খড়ি দিয়ে শিখিয়ে দেন যে, কিভাবে বাস্তব জীবনের আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে সুন্দর ভাবে জীবনকে সহজ পথে পরিচালনা করতে হয়। বাবা ছাড়া একজন সন্তানের যে অপূর্ণতা থাকে, পৃথিবীতে আর এমন কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই যে সেই সন্তানের পরিপূর্ণতা এনে দিতে পারে।
একজন বাবা হচ্ছে তার সন্তানের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বাবা এবং সন্তানের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এমন এক ভালোবাসা সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে দিয়েছেন যার বন্ধন ছিন্ন করার ক্ষমতা এই পৃথিবীতে কারও নেই শুধুমাত্র মালিক সৃষ্টিকর্তা ছাড়া। বাবার থেকে পাওয়া এই পবিত্র ভালোবাসাটুকু পৃথিবীতে আর অন্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নই। সন্তানের জীবনে বাবার অসামান্য অবদান অস্বীকার করার কোনো জায়গায় ই নেই। প্রতিটি বাবা তার সন্তানের জন্য ঢালস্বরূপ। সন্তানের তুচ্ছ মঙ্গলের জন্য হাজারও ত্যাগ স্বীকার করেন পৃথিবীর প্রতিটি বাবা। বাবা এভাবেই নীরবেই সন্তানের জন্য হাজারো পরিশ্রমের চেষ্টা করে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায় বাবা সন্তানকে অনেক বকাঝকা দিয়ে থাকেন, সামান্য কারণে সন্তানের সাথে রাগারাগি করেন। কিন্তু এতে পরক্ষণেই বাবাই বেশি কষ্ট পেয়ে থাকেন। সন্তান বাবার প্রতি অভিমান করে থাকলেও বাবারা সেটা পারেন না। বাবা সন্তানকে যতোটুকু শাসন ই করেন না কেন তা সন্তানের ভালোর জন্যই করে থাকেন। বাবাই তো সন্তানের ভুলগুলোকে ধরিয়ে দিয়ে সামনে সঠিক পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করেন, সাহায্য করেন। তাই বাবাদের শাসনকে কখনোই অভিমানের চোখে দেখা উচিত নই। তাদেরকে সম্মান করা দরকার, তাদের কষ্ট, শ্রম, ত্যাগকে অবশ্যই সন্তানের মূল্যায়ন করা উচিত। একজন বাবার যেমন দায়িত্ব সন্তানকে বড় করা, সন্তানের ভবিষ্যৎ সুন্দর করে দেওয়া, তেমনই প্রতিটি সন্তানেরও কর্তব্য বাবার কথামতো সঠিক পথে চলা, তাকে সেবা যত্ন করা।
অনেকে মনে করে যে, বাবারা শুধু শাসন করেন, তারা স্বার্থপর, মায়েদের মতো ভালোবাসেনা তারা। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। বাবাও সন্তানকে অনেক ভালোবাসেন, অনেক আদর- যত্ন করেন। সন্তানেরাই অনেক সময় সেটা বুঝে উঠতে পারেনা। ভাবে, বাবা শুধু শাসন ই করেন। কিন্তু বাবারা ওতোটুকু শাসন তো আমাদের ভালোর জন্যই করে থাকেন। বাবারা নিঃস্বার্থ। সন্তানের কল্যাণের জন্য, পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান প্রতিটি বাবা। বাবার পছন্দের বিষয়ে জানা খুবই মুশকিল। তারা হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র পোশাকে কাটিয়ে দেন বছরের পর বছর বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ছাড়া। নিজের প্রিয় খাবার কী, নিজের পছন্দ কী, অপছন্দ কী তা হয়তো একেবারেই ভুলে যান। কিন্তু সন্তানের প্রিয় পোশাক, প্রিয় খাবার, প্রিয় জিনিস, সব প্রয়োজন সবটা থাকে নখদর্পনে।
সন্তানের বেড়ে ওঠায় বাবার ভূমিকা অতুলনীয় হলেও তা পড়ে থাকে এক পাশে। তবে, বাবাবে নিয়ে সন্তানেরও গর্ব হয়। কোথাও একটা পড়েছিলাম, প্রতিটা স্বার্থক, স্বাবলম্বী মেয়ের একজন বাবা আছেন যে তার মেয়েকে বিশ্বাস করেন, সমাজকে নয়। কথাটি আমার জন্য পুরোপুরি সত্য। কিন্তু আশেপাশের বাকি আট- দশ জনের মতো আমি বাবার প্রতি আমার ভালোবাসা ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারিনি কোনদিনই, তবে কমতি নেই বিন্দুমাত্রও। ঘটা করে শ্রদ্ধা ভরে ভক্তি প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি কখনো ঠিকই কিন্তু অপ্রকাশিতভাবে ভক্তি – শ্রদ্ধার কোনো কমতি নেই। হয়তো বাবাদের প্রতি অধিকাংশ সন্তানের ভালোবাসাই বুঝি এইরকম অপ্রকাশিত হয়ে থাকে।
আমার বাবা আমার মহানায়ক, আমার জীবনযুদ্ধের সত্যিকারের নায়ক, আমার আদর্শ। বাবা এমন এক অনুভূতির নাম যা কখনো মুখে বলে বা খাতায় লিখে শেষ করা যাবে না। সন্তানের অভাব, অভিযোগ বা অনুযোগ বাবাকেই বলা হয়ে থাকে। আরও বলা হয় অনেক কথাই। তবুও কেন যেন আরও থেকে যায় বিশাল কথার পাহাড়। যা বলবো বলবো করে কখনোই বলা হয়ে ওঠেনা। কিছুটা অভিমানে, হয়তোবা কিছুটা মধ্যবিত্তের সংকোচে কিংবা বাকিটা গোপনে- সেই কথাগুলো থেকে যায় কেবলই নিজের ভিতরেই। ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় বলা হয়ে ওঠেনা বাবার প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা বা মুগ্ধতার কথা।
বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষ আছেন যারা মাতা-পিতার কদর না বুঝে বৃদ্ধ বয়সে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে দিয়ে আসেন। ধিক্কার জানাই সেই কুরুচিপূর্ণ মানুষকে যারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদকে চিনতে পারে না। বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে টাকা লাগে না। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যাওয়া বাবাকে যেকোনো পরিস্থিতিতেই ভালোবাসা উচিত। মায়ের প্রতি ভালোবাসার অন্তরালে বাবার প্রতি ভালোবাসা আজীবন প্রতিটি সন্তানের অন্তরে স্থায়ীভাবে বসবাস করুক। সন্তানেরাও যদি বাবাকে ভালোবাসে, সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে তাহলে পৃথিবীর সমস্ত বাবাই ভালো থাকবেন। আর প্রতিটা সন্তানও সুখী হবে।