- সৈয়দ শামসুল হুদা
সদ্য কারামুক্ত মাওলানা মামুনুল হক সাহেব একটি বিষয় খুব পরিস্কার করে বলছেন যে, আমাদের জেল জীবনের জন্য কোনো আলেমদের দায়ী মনে করি না, কাউকে কোনো প্রকার দোষারূপ করি না। কারো এমন কোনো ক্ষমতাও নেই যে, তারা আমাদেরকে জেলে ঢুকাবে। তবে তিনটি বিকল্প হতে পারে। এক। কোনো কারণে আমাদের এই জেল জীবনের জন্য তারা হয়তো মনে মনে খুশি। দুই। আমাদের জেল মুক্তির জন্য তাদের যতটুকু করণীয় ছিল, তারা তার কিছুই করেন নাই। তিন। একেবারেই নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। এটা কোনো অপরাধ না। এটা হতেই পারে। তবে আমাদের ওপর জুলুম নির্যাতন এর জন্য দায়ী সম্পূর্ণরূপেই ক্ষমতাসীন সরকার। তারাই পরিকল্পিতভাবে আমাদের ওপর জুলুম করেছে।
এখন অনেকেই আবার আমাদের এ কথা বিশ্বাস করাতে চায় যে, অমুকের কারণে আপনাদের জেল হয়েছে। অমুকের কারণে আপনাদের মুক্তি হয় নাই। এগুলো বলে আমাদের মাঝে আরও বেশি বিভক্তি বাড়াতে চায়। আমরা এ বিভক্তিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিবো না। কিন্তু আমাদের এই জেল-জুলুম এ যতটা না কষ্টের কারণ হয়েছে, যতটা না আমরা কষ্ট অনুভব করেছি, তারচেয়ে অধিক কষ্ট অনুভব করি, আমাদেরই কোনো আলেমকে যখন দেখি- তারা জালেমদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে। তারা জালেমদের প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর সাথে ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন রহ. এর সম্পর্কের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, তৎকালীন শাসক ‘খালকে কুরআন’ নিয়ে সত্য বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল, তখন সরকারের চাপে ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন জুলুম-নির্যাতনের ভয়ে সরকারের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়ার কারণে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. সারাজীবন ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন রহ.কে আর সাক্ষাতের সুযোগই দেননি।
তদ্রুপ আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. যখন আইয়ুব খান তথাকথিত ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ করছিল, তখন উলামায়ে কেরাম প্রতিবাদ করছিলেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন, আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.। তো এটা সরকারের জন্য সমস্যার কারণ হচ্ছিল। আইয়ুব খান আলেমদের সাথে বসার চাইলেন। আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. হকের ঝান্ডা নিয়ে আইয়ুব খানের দরবারে দীনি গায়রত ও হায়বত নিয়ে সরকারী ভবনে গমন করে দেখতে পান যে, তৎকালীণ এক প্রচন্ড প্রতাপশালী আলেম সরকারের সাথে বসে হাসি-খুশি খোশগল্প করছে। এটা দেখে আল্লামা ফরিদপুরী রহ. এর আইয়ুব সরকারের প্রতি যতটা না ক্ষোভ ছিল, তারচেয়ে হাজার গুণ বেশি ক্ষোভ তৈরি হয় ঐ আলেমের ওপর।
কারণ ছিল, আলেম-উলামাদেরকে এখানে ডাকা হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমাধানের জন্য। আর সেখানে একজন আলেম নিজের ব্যক্তিত্ব ও দীনি দায়িত্বের জায়গায় এতটা ব্যক্তিত্বহীন দেখে যারপর নাই ক্ষুদ্ধ হন। এমনকি সেই আলেমকে আমৃত্যু অনেক চেষ্টা করার পরও আর সাক্ষাতের সুযোগ দেননি।
এই কথা বলে তিনি বুঝাতে চান, আমরা জেল খেটেছি, জুলুমের শিকার হয়েছি, এতে কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু যখন দেখবো যে, কোনো আলেম নানা ছল-চাতুরি করে সেই সরকারের সাথে দহরম-মহরম সম্পর্ক রাখবেন, তোষামোদি করবেন, গালগপ্প করবেন, এটা দেখলে আমরা অনেক বেশি কষ্ট পাবো। বাঘকে বাগে পেয়েও যে বাঘের প্রতি করুণা করে, সে মূলতঃ ছাগল ও হরিণের ওপর জুলুম করে, যে নিরীহ।
বাংলাদেশের হাজারো-লাখো আলেম- উলামা, দীনদার ফ্যামিলির ওপর সরকারের চালিত জুলুমের আহাজারি চলছে। এমন অবস্থায়ও যদি এটা দেখি যে, কোনো আলেম সরকারের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্কই শুধু নয়, তাদের গুণকীর্তনও করে- তাহলে তার সাথে আমাদের কোনো বন্ধুত্ব হতে পারে না। তার সাথে কোনো আপোষ হতে পারে না।
এ বক্তব্যটির সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। জালেমদেরকে আলেমদের থেকে নিঃসঙ্গ না করতে পারলে এই জালেম সরকার আরো বেশি জুলুম করার সাহস পাবে। মামুন সাহেবের বক্তব্যের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে। এতে একদিকে ঐ সকল আলেম যারা সরকার ও রাষ্ট্রের বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসেবে কাজ করে, তাদের পরিচয় উম্মুক্ত হয়ে যাবে। দ্বিতীয়তঃ সরকার আলেমদের ভেতরকার দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তথ্য প্রাপ্তিতে ব্যাঘাত ঘটবে।
জেল ফেরত মাওলানা মামুনুল হককে কথা ও দায়িত্বের জায়গা থেকে আরও অনেক বেশি পরিপক্ষ মনে হচ্ছে। এর মাধ্যমে আলেমদের ভেতরকার মূল সমস্যাটা উনি চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন, দ্বিতীয়তঃ আলেমদের ভেতরকার অনৈক্যের যে অবস্থাটা ছিল সেটা কিছু হলেও হ্রাস পাবে।
জনাব মামুনুল হক সাহেবের সাথে সাক্ষাতে এটা মনে হয়েছে যে, তিনি এখন দুনিয়াবিমুখ জিন্দেগীকেই প্রাধান্য দিতে চান। অর্থ-বিত্তের দিকে আর কোনোরূপ গুরুত্ব দিতে চান না। আলেমদের মধ্যে যে নৈতিক অধঃপতন ঘটেছে, যেটা বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সঙ্কট আলেমদের জন্য, সেই দিকটায় তিনি গুরুত্ব দিতে চান। ঐ ময়দানে তিনি কাজ করতে চান।
প্রকৃতপক্ষে এটা বড় একটি পরীক্ষা। ইদুঁর যদি ভেতর থেকে জাল কাটে, তাহলে জালের সুরক্ষা দেওয়া অনেক কঠিন। আলেম সমাজের জন্য কলঙ্কের বিষয় হলো- কতিপয় আলেম পরিচয়দানকারী ব্যক্তি, বর্তমানে সরকারের অভ্যন্তরীন এজেন্সি ও প্রশাসনিক শক্তির সাথে এক ধরনের আঁতাত ও বিবেকবর্জিত রাষ্ট্রীয় শক্তির তোষামোদী বড় ধরনের ক্ষতির কারণ।
মামুনুল হক সাহেব একঢিলে দুই পাখি মারছেন। সেটা হলো, আলেমদের থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তথ্য পাচারের যে চিত্র সেটা যেন বন্ধ হয়। আর দ্বিতীয়টা হলো: সরকার যেন আরও বেশি আগ্রাসি না হয়। আলেমদের বিরুদ্ধে আলেমদেরকেই সহযোগি হিসেবে কাউকে না পেলে সরকার বেশি জুলুম করতে পারবে না। বেশিদূর এগুতে পারবে না।
আমি মনে করি, এটা মামুন সাহেবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়ও বটে। রাষ্ট্রীয় জুলুম-নির্যাতনের জন্য নিজেদের লোকদেরকেই দোষারূপ করে সরকারকে দায়মুক্তি দেওয়ার তিনি পক্ষপাতি নন। এ সুযোগ তিনি সরকারকে দিতে চান না। এটা সরকারের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক পরাজয় হবে।
০৮..৬.২০২৪