
আশরাফুল হক
আল্লামা মামুনুল হক দা. বা. দলের বিস্তৃতিতে মনোযোগ দিয়েছেন, এটি একটি আশার কথা। আমাদের সবচে দুর্বলতা এখানেই। সাংগঠনিক শক্তি শূন্যের কোঠায়। বলতে দ্বিধা নেই, হেফাজতের মতো বিজয়ী শক্তির অকাল অপমৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ ছিল সাংগঠনিকতা চর্চার অনুপস্থিতি।
মামুনুল হকের দল-বিস্তৃতি একদিকে যেমন আশার, একই সঙ্গে একটু শঙ্কারও। শঙ্কাটা বলছি একটি উদাহরণ টেনে।
২০১৮ এর নির্বাচন ঘিরে ‘মাসিক ইসলামী পয়গাম’-এ একটি কলাম লিখেছিলাম ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে। শিরোনাম ছিল— ‘গোস্তাখি মাফ করবেন’। সেটি ঠিল আশা-নিরাশা এবং শঙ্কা ও নিঃশঙ্কার আলাপ। পুরো লেখায় দলটির অগ্রগতি নিয়ে যেমন আশা প্রকাশ করেছিলাম, তেমনই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম কিছু বিষয়ে।
সেই শঙ্কাগুলো আজও কতটুকু প্রাসঙ্গিক, তার প্রমাণ হাসিব আর রহমানের সাম্প্রতিক পোস্ট থেকে অনুমেয়। পোস্টের নির্বাচিত অংশ এখানে দিচ্ছি, পুরো পোস্টের লিঙ্ক কমেন্টে থাকবে। হাসিব ভাই লিখেছেন—
“(বিভিন্ন জরিপে) ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তথা চরমোনাই দল সবচেয়ে খরাপ পারফরমেন্স করার একটা বিশেষ কারণ হলো এই দলের আসল নামই মানুষ জানে না। বাংলাদেশে দলীয় ব্রান্ডিং পয়েন্টে সবচেয়ে দুর্বল এবং আন্ডাররেটেড দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এর একমাত্র কারণ এখানে পলিটিক্যাল ডিসকাশন করার লোকজন খুবই কম। এডভান্স লেভেলের রাজনৈতিক কোনো গবেষণা টিম এখানে নাই।
এইসব রাজনৈতিক পয়েন্ট নিয়ে রাজনৈতিক গবেষণা, নিজেদের রাজনৈতিক রিসার্চ টিম, ব্রান্ডিং টিম, পিআর টিম তথা মিডিয়া নিয়ে আলাদা কাজসহ এডভান্স লেভেলের পলিটিক্যাল কোনো কাজ এখানে হয় না। এখানে পলিটিক্যাল ডিসকাশন খুবই অদ্ভুত রকমের হয়। অথচ এখনকার এই রাজনৈতিক জার্নিতে এগুলো সবার আগে প্রয়োজন ছিলো।”
এই কথাগুলোই আমি বলেছিলাম আমার ভাষায়, আমার আঙ্গিকে।
উল্লেখ্য, হাসিব ভাই দলের ভিতরে থেকেই রয়েসয়ে অনেক কথা বলেন। এটাই একধরণের সাংগঠনিক দায়বদ্ধতা। দলের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলা, তবে সেটা টানটান উত্তেজনাকর ও আক্রমণাত্মক না হওয়া। এমনকি খালিদ সাহেবের প্রসঙ্গেও তিনি কড়া কথা বলেছেন, যদিও সেই পোস্ট আন-পাবলিক করেছেন মেবি।
জানি, আমার এই লেখা আল্লামা মামুনুল হক পর্যন্ত পৌঁছবে না। হয়ত পৌঁছার দরকারও নেই, কারণ তিনি যে এ বিষয়গুলো বোঝেন না, তা না। তবু সময়ের দায়ে কথাগুলো বলে নিজেকে একটু ভারমুক্ত ভাবার চেষ্টা করছি।
এবার আসল কথা বলে শেষ করি—
মামুনুল হকের দলের বিস্তৃতি অনেক ক্ষেত্রেই অদক্ষ ও অযোগ্য মানুষদের হাত ধরে হচ্ছে বলে মনে হয়। এবার এমনও মানুষদের রিক্সার প্রার্থী হতে দেখছি, যাদের ব্যাপারে কিছুই বলার নেই। তিনি যোগ্য কিনা, সেই প্রশ্নই লজ্জাজনক। এমন প্রার্থী বিচার করতে হয় কেন? জনতার কাছে কী বার্তা যায়?
দলের বিস্তৃতি ঘটানোর প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা এখনও অঙ্কুরেই আছে। এখন থেকেই কিছু বিষয় সর্বোচ্চ লক্ষ রাখতে হবে। দলে সর্বোচ্চ মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্যদের সমাবেশ ঘটাতে হবে। কারও আসার অপেক্ষা না করে মেজর জিয়ার মতো দক্ষ লোক খুঁজে খুঁজে তাদের ইনভাইট করতে হবে। শুধু আলেম খুঁজলেই হবে না, ইসলাম ধারণকারী নন-আলেমদেরও দলে আনতে হবে। বিভিন্ন এলাকায় নামস্বর্বস্ব লোকদের এবং ‘চার দেয়ালের বিলাসী বাদশাহ’দের পদায়ন করা যাবে না।
জনগণের কাছে নিজেদের রাজনৈতিক বয়ান সুস্পষ্ট রাখতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ, এ বিষয়টি মামুনুল হক এখনও করছেন বলে মনে হয়। বিশেষত খালেদ মহিউদ্দিনের প্রশ্নের জবাবে নিজেদের খেলাফত-চিন্তার যে সুস্পষ্ট কথা বলেছেন, তা ধরে রাখতে হবে। জামাতের মতো ইসলামের নামে রাজনীতি করে ইসলাম নিয়ে একেক নেতার একেক কথার মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয়ের দুর্বলতা দেখানো যাবে না।
কর্মী ও নেতাদের মন থেকে আত্মতৃপ্তি ও আত্মগরিমা দূর করার পদক্ষেপ রাখতে হবে। আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসমালোচনা করতে হবে নির্মোহ ও নির্মমভাবে। সমালোচক মানেই তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা যাবে না। পরমতসহিষ্ণুতা বর্তমান সমাজের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয়। নেতা-কর্মীদের এসব বিষয়ে দীক্ষায়িত করতে হবে।
কল্পবিলাস থেকে বের হয়ে জনতার কাতারে নামতে হবে। নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা যে গতিতে চলবে, একই গতি ধরে রাখতে হবে নির্বাচনের পরেও। ভোটের রাজনীতি, জনতার ভাষা, জনতার প্রত্যাশা ইত্যাদি আত্মস্থ ও অনুধাবন করতে হবে। নেতাকর্মীদের কাছে জনতার মুখে ‘আল্লামা মামুনুল হক’ শোনার চেয়ে ‘মামুন ভাই’ শোনা বেশি পছন্দনীয় হতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলতা নয়, ক্রিয়াশীলতা অর্জন করতে হবে। এক্সপার্টদের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের ইসলাম-তন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞান, পলিটিক্যাল সাইন্স ইত্যাদির একাডেমিক, থিমেটিক ও প্রাকটিক্যাল প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
দলের বিস্তৃতির সূচনা থেকেই এসব বিষয় লক্ষ না রাখলে ইসলামী আন্দোলনের মতো বিপত্তিতে পরতে হবে। আমার কথা সুস্পষ্ট। রাষ্ট্র চলে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততা দিয়ে। শুধুই সততার ফেরি করে দিনশেষে সততাকে হাস্যরসে রূপান্তরিত করা যাবে না। আজ যদি ইসলামী আন্দোলনের কাছে ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের রাষ্ট্রকল্প চাওয়া হয়, রাষ্ট্র পরিচালনার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া দলটিকে লজ্জায় পড়তে হবে। একশজন দক্ষ মানুষ তারা দিতে পারবে না। আজ তারা ক্ষমতায় এলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্ভর করতে হবে সেই দুর্নীতিগ্রস্ত অসৎদের উপর। তখন সততার শ্লোগান ভীষণ দুর্বিপাকে পড়বে। অন্য দলের লোকদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা কেমন হয়, ইউনুসের মতো বিশ্বনন্দিত ব্যক্তি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
প্রশ্ন থাকে— তাহলে ইসলামী আন্দোলন দশকের পর দশক ধরে কী করেছে? যারা নিজেদের গঠন করতে পারেনি, তারা রাষ্ট্র গঠন কীভাবে করবে?
আজ থেকে দশ বছর পর আল্লামা মামুনুল হকের দলও একই ক্লান্তি বয়ে বেড়াবে না, জাতিকে আশা দেখিয়ে নিরাশায় ডোবাবে না—সেই প্রত্যাশা রইল।




