পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশ ইরান। এর উত্তর-পশ্চিমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান, উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তর-পূর্বে তুর্কমেনিস্তান, পূর্বে আফগানিস্তান, দক্ষিণ-পূর্বে পাকিস্তান, দক্ষিণে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগর এবং পশ্চিমে তুরস্ক ও ইরাক অবস্থিত। প্রাচীন কাল থেকেই ভৌগলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক বিবেচনায় ইরান গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।
ইরানে অনেক মুসলিম মনীষী জন্ম গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ইমাম গাজালী, মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ, আল-বেরুনী, শেখ সাদী, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা। হাদিস বিশারদ, ধর্মতত্ত্বত, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সাহিত্য তাদের অবদান অবিস্মরণীয়।
মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ
পূর্ণ নাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল কুশায়রী আন নিশাপুরী। তিনি খুরাসানের অন্তর্গত নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত আলেম, হাদিস বিশারদ ও শাস্ত্রজ্ঞ। তিনি আল-ইমাম, আল-হাফেজ, হুজ্জাতুল ইসলাম ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত ছিলেন।
শৈশব থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের সব কেন্দ্রেই যান। বিশেষ করে ইরাক, হিজায, মিশর প্রভৃতি অঞ্চল। তিনি সেখানে অবস্থানকারী হাদীসের শ্রেষ্ঠ উস্তাদ ও মুহাদ্দিসের কাছ থেকে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন ।
তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো সহীহ মুসলিম শরীফ সংকলন রচনা করা। এছাড়াও তিনি ১৮টি গ্রন্থ রচনা করেন। তবে মুসলিম শরীফ ছাড়া অন্য রচনাগুলো এখন পাওয়া যায় না।
ইমাম গাজালী
ইমাম গাজালীর পূর্ণ নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ তুসী আল-গাজালী।
ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৪৫০ হিজরি সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অন্যতম এবং প্রভাবশালী দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ, আইনবিদ, যুক্তিবিদ ও সুফি হিসেবে পরিচিত। তিনি ইমাম গাজালি হিসেবে বিশ্বখ্যাত। তাকে পঞ্চম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে ইমাম গাজালীর জন্মের সময় পাশ্চাত্য ও গ্রিক দর্শনের বিস্তার লাভ করছিল। গ্রিক দর্শন গভীরভাবে অধ্যায়ন করে তার সমালোচনা করেন তিনি। তিনি ইসলামকে মধ্যযুগীয় অনৈসলামিক দার্শনিকদের প্রভাব থেকে মুক্ত করে কোরআন-হাদিসের শিক্ষায় মুসলমানদের ফিরিয়ে আনেন। তাই তাকে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বলা হয়ে থাকে।
ইমাম গাজালি রহ. চারশ’রও অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তার অধিকাংশ বইগুলোতে ধর্মতত্ব, দর্শন ও সুফিবাদ আলোচনা করেছেন। এহইয়া উলুমুদ্দীন, তাহাফাতুল ফালাসিফা তার প্রশিদ্ধ গ্রন্থ।
আল-বেরুনী
আল-বেরুনীর পূর্ণ নাম আবু রায়হান আল-বেরুনী বা আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল-বেরুনী।
৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে খাওয়ারিজমের শহরতলিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
আল-বেরুনী নামে পরিচিত তিনি। তিনি ইসলামী স্বর্ণযুগে একজন খাওয়ারেজমিয় ইরানি পণ্ডিত এবং বহুবিদ্যাবিশারদ ছিলেন। তাকে বিভিন্নভাবে ইন্ডোলজির প্রতিষ্ঠাতা, তুলনামূলক ধর্মের জনক, আধুনিক জিওডেসির জনক এবং প্রথম নৃতত্ত্ববিদ বলা হয়। তিনি অত্যন্ত মৌলিক ও গভীর চিন্তধারার অধিকারী ছিলেন।
তিনি ছিলেন গণিত, জ্যোতিঃপদার্থবিদ, রসায়ন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পারদর্শী। অধিকন্তু ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক, পঞ্জিকাবিদ, দার্শনিক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্বের নিরপেক্ষ বিশ্লেষক।
বিরুনির লেখা ১৪৬টি বইয়ের মধ্যে ৯৫টি জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং গাণিতিক ভূগোল সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে রচিত। তিনি হিব্রু বর্ষপঞ্জি নিয়ে আলোচনা করার সময় প্রথম ঘণ্টাকে সেক্সজেজিসিভাবে মিনিট, সেকেন্ড, তৃতীয় এবং চতুর্থ ভাগে ভাগ করেছিলেন। পাহাড়ের উচ্চতা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয় করার একটি অভিনব পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। লিখেছিলেন একটি ফার্মাকোপিয়া, "কিতাব আল-সায়দালা ফি আল-তিব্ব" (ঔষধের প্রস্তুত প্রণালী বই)।
ওমর খৈয়াম
ওমর খৈয়ামের পূর্ণ নাম গিয়াসউদিন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম নিশাপুরী।
১০৪৮ খিস্টাব্দে ইরানের নিশাপুর শহরে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি একাধারে বিখ্যাত কবি, গণিতবিদ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ। কাব্য-প্রতিভার আড়ালে তার গাণিতিক ও দার্শনিক ভূমিকা অনেকখানি ঢাকা পড়েছে।
ওমর খৈয়াম দিনের বেলায় জ্যামিতি ও বীজগণিত পড়াতেন, সন্ধ্যায় মালিক-শাহ-এর দরবারে পরামর্শ প্রদান এবং রাতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা করতেন। কোনো কাজেই নিষ্ঠার কমতি ছিল না তার।
ওমর খৈয়াম ছিলেন প্রথম শ্রেণির গণিতবিদ। ইসলামী সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সোনালী যুগে বীজগণিতের যেসব উপপাদ্য এবং জ্যোতির্বিদ্যার তত্ত্ব ওমর খৈয়াম দিয়ে গেছেন সেগুলো এখনও গণিতবিদ এবং মহাকাশ গবেষক বা জ্যোতির্বিদদের গবেষণায় যথাযথ সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি পরাবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। এছাড়া তিনি দ্বি-পদী রাশিমালার বিস্তার করেন।
ওমরের আর একটি বড় অবদান হলো ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা যা পরবর্তী সময়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে।
ইবনে সিনা
তার পূর্ণ নাম আবু আলি হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান বিন আলী ইবনে সিনা।
ইবনে সিনা বুখারার (বর্তমান উজবেকিস্তান) অন্তর্গত খার্মাতায়েন জেলার আফসানা নামক স্থানে ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি আবু আলী সিনা, পুর সিনা বা পাশ্চাত্যে আভিসেনা নামেও পরিচিত। তাকে ইসলামি স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, চিন্তক, লেখক এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক গণ্য করা হয়। তর্কসাপেক্ষে প্রাক-আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক।
ধারণা করা হয়, তিনি ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার মধ্যে ১৫০টি দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক এবং ৪০টি চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাসহ মোট ২৪০টি গ্রন্থ বর্তমানে টিকে রয়েছে।
তার সর্বাধিক বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে কিতাবুশ শিফা অন্যতম, যেটি একটি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ। তার আরেকটি এমন প্রসিদ্ধ গ্রন্থ কানুন ফিততিব একটি চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ। যা বহু মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রামাণ্য চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ্যবই হিসেবে যুক্ত করা হয়েছিল। ১৬৫০ সাল পর্যন্ত গ্রন্থটি সরাসরি পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে।
তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, বিশেষ করে গতির ধারণা এবং বল ও শক্তি সম্পর্কিত তত্ত্ব বিকাশে। তিনি "নিস্পত্তির গতি" (inertia) বিষয়ে ধারণা প্রদান করেন, যা পরবর্তীতে গ্যালিলিও এবং নিউটনের তত্ত্বের পূর্বসূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
দর্শন এবং চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও ইবনে সিনার রচনা সংকলনে জ্যোতির্বিজ্ঞান, আলকেমি, ভূগোল এবং ভূতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং কবিতা বিষয়ক লেখাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।