
মিযানুর রহমান জামীল
চারদিক কাঁপিয়ে রাজপথ মুখোর হয়ে ওঠেছিল সেদিন। শাপলা চত্বরে লাখো জনতার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক লংমার্চ।২০১৩ সালের ৬ এপ্রিলের প্রজন্ম দেখেছিল মহা এক জাগরণ। সারা দেশ থেকে শাপলায় যোগ দেয় ধর্মপ্রাণ মানুষ। ঢাকার দিকে ছিল গণমানুষের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার। ফ্লাইওভারের শেষ সীমানা পর্যন্ত দীর্ঘ মিছিল। পূর্ণ হয়ে ওঠে সড়ক মহাসড়ক। কাকরাইল থেকে রমনা, কমলাপুর থেকে আরামবাগ, বাবুবাজার থেকে গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ি থেকে জনপথ, প্রতিটি পয়েন্ট মতিঝিলে একাকার হয়ে যায়। এগিয়ে চলে সাদা টুপি আর পতাকার কাফেলা। উঁচু দালান আর বহুতল ভবনগুলোয় প্রতিধ্বনিত হয় আল্লাহু আকবারের সুর।
ঢাকা অভিমুখে হেফাজতে ইসলামের
লংমার্চ কর্মসূচিতে অংশ নেয় মাদরাসা স্কুল কলেজ ভার্সিটিসহ জনসাধারণের বিশাল বহর। নাস্তিক বিরোধী এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন দেশের প্রবীণ আলেম শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ.।
৬ এপ্রিল লংমার্চের পর জেলায় জেলায় শানে রেসালাত সম্মেলন সংঘটিত হয়। নাস্তিকবিরোধী আন্দোলনের এ গণমুখী জোয়ারে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে হেফাজতে ইসলামের নাম । এর ৩০ দিন পর ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির ডাক আসে। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। হামলা মামলার ভয় দেখিয়ে, জেলায় জেলায় গাড়ি আটকিয়ে, ঢাকার প্রবেশ পথে চেকপোস্ট বসিয়েও অবরোধ বানচাল করতে পারেনি। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আগের দিন রাতেই ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকে হেফাজতে ইসলামের লাখো কর্মী।
শত বাধা প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে, রাষ্ট্রীয় বাধা উপেক্ষা করে, কাকর বিছানো পথ মাড়িয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে তৌহিদী জনতার বহর।হেফাজতের ডাকে ঈমানী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজপথে রক্ত ঝরিয়ে কর্মীরা শাপলায় জড়ো হতে থাকে। দুপুরের আগেই মতিঝিল থেকে আরামবাগ, দৈনিক বাংলা মোড় হয়ে বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত কর্মীদের সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যায়।
সরকারের পেটুয়া বাহিনী ও একটি কুচক্রী মহল কুরআন শরীফ এবং বইয়ের দোকানে আগুন লাগিয়ে অবরোধ কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ অবস্থানকে ধীরে ধীরে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আকাশের মেঘ আর কালো ধুয়া একাকার হয়ে যায়।
ইতোমধ্যে স্টেজের সামনে কয়েকটি রক্তাক্ত লাশ নিয়ে আসা হয়। এ দৃশ্য দেখে কান্না আর ক্ষোভে ফেটে পড়েন অনেকেই। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দুহাত তুলে মুরুব্বিরা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানান। নেতৃবৃন্দ শাপলার মঞ্চ থেকে শক্তি সাহস আর মনোবল নিয়ে জাগরণ অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন। কর্মীদের অনেকে ভয় আতঙ্ক আর অজানা আশঙ্কায় ভুগলেও মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে তৈরি হয়ে যান। আমীরে হেফাজতের অপেক্ষায় রাতে সবাই শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন।
আমীরে হেফাজতের জন্য অপেক্ষা দীর্ঘ হতে থাকে। রাত ১০টায় পরিবেশ কিছুটা হালকা হলেও ভয় কাটেনি অনেকের। সঙ্গে থাকা প্রয়োজনীয় আসবাব হাতছাড়া। কারও চশমা, ঘড়ি, কারো টুপি আবার কারও জুতা এমনকি হাতের যোগাযোগ ব্যবস্থার মোবাইলটাও সময়ের ব্যবধানে অদৃশ্য হয়ে গেল। সারা দেশের মানুষ অবস্থা জানার জন্য বসে আছেন টিভির পর্দার সামনে। কিন্তু সরকারকর্তৃক চ্যানেলগুলো কৌশলে চাপপ্রয়োগ করে রাতেই সরিয়ে দেয়া হয়।
মধ্যরাত। কেউ তাহাজ্জুদ নামাযে দাঁড়ানো, কেউ জিকিরে ব্যস্ত। আবার সারা দিনের ক্লান্তির কারণে কারও চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। এরই মধ্যে অনেকে অবস্থান নেন পাশ্ববর্তী মসজিদ ও বহুতল ভবনের নিচের সম্মুখ করিডোরে। কেউ ফিরে যান নিকটস্থ মাদরাসা বা এতিমখানায়। শাপলায় তখনও অর্ধ লক্ষ কর্মী। দৈনিক বাংলার দিক থেকে নেমপ্লেটের লাইটগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এক সময় শাপলা ও তার আশপাশে দুনিয়ার অন্ধকার নেমে আসে। ঠিক তখনই আকাশে বিদ্যুৎ চমকিয়ে বোমা ফাটতে থাকে। বিকট আওয়াজে চারদিক আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
মঞ্চের মাইকগুলো বন্ধ। কর্মীরা কোনো নির্দেশ না পেয়ে দিকবিদিক ছুটতে থাকে। কেউ কেউ
ঘুম থেকে উঠার আগে বুলেট বিদ্ধ হয়। পুলিশ এবং ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসের লাঠির আঘাত কর্মীদের মাথা থেতলে দিতে থাকে। যাকে যেভাবে পায় পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে রক্তাক্ত করে আধমরা বানিয়ে তারপর ছেড়ে দেয়। অনেকের বাঁচার আকুতি তাদের কাছে শিশুদের খেলনার চেয়ে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অপমান অপদস্ত করে গায়ের পোশাক ছিঁড়ে মাথা ফাটিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। এরই মধ্যে অনেকেই পরপারে পাড়ি জমায়। সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয় অসংখ্য কর্মীকে।
এরপর কাউকে মারা হয়েছে তিলে তিলে। চিকিৎসকের উপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করে অনেককে মারা হয়েছে হসপিটালের বিছানায়। কাউকে বন্দি করে জেল থেকে জেলে, কাউকে মামলা দিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবার কাউকে এলাকায় নজরবন্দি করেও ১১টি বছর চাপে রাখা হয়। সেদিন জাতি দেখেছিল বাকস্বাধীনতার চরম বিপর্যয়। এ জুলুম অত্যাচারের পরও একশ্রেণির সহজাতকে একটুও অনুশোচনা করতে দেখা যায়নি।
কবির ভাযায়—
স্বাধীন থেকেও লাভ কি যাদের
বন্দি বিবেক পিঞ্জিরে
জ্ঞান গরীমার বড়াই তাদের
খাক চেটে খাক খিঞ্জিরে।
তারা কি জানে? আমাদের এ কাফেলা মিলিত হবে খোরাসানের কালো পাগড়িওয়ালাদের কাফেলায় ইনশাআল্লাহ।
সহ সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম