JuboKantho24 Logo

স্মৃতিকথায় শাপলা চত্বর

  • যোবায়ের আহমদ নোমান
আমাকে কখনো যদি প্রশ্ন করা হয় জীবনের সবচেয়ে তরতাজা স্মৃতি কোনটি? অতীতের কোন গল্পটি চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে? এই দুরূহ প্রশ্নের উত্তরে আমি একমূহুর্তও না ভেবে বলবো ২০১৩ সালের ৬ ই এপ্রিল লংমার্চের কথা, ৫ ই মের ভয়াবহ কালো রাত্রির কথা। শাপলা চত্বরের স্মৃতি আজও আমায় তাড়া করে বেড়ায়!
এক,
সালটা ২০১৩। আমি তখন কিশোর। নবী প্রেমিক অতি জযবাতী এক কিশোর। দ্বীনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারাটাই ছিলো একমাত্র স্বপ্ন। ফেব্রুয়ারী জুড়ে শাহবাগে নাস্তিকদের আন্দলোন চলছিলো। আন্দোলনের নামে চলছিলো ইসলাম বিদ্বেষী আর নাস্তিকতা। সময় গড়িয়ে শাহবাগ হয়ে উঠে নাস্তিক ব্লগারদের আশ্রয়স্থল। নারী-বাজ নারীবাদীদের মিলনমেলা। পৃথিবীর সকল শয়তান যেন এক হয় শাহবাগে এসে। শাহবাগী ধর্মের পূজা দিনদিন ছড়িয়ে পড়ছিলো শহর নগর বন্দরে। ঠিক সে সময় হকের ঝান্ডা নিয়ে আবির্ভাব হলো আল্লামা আহমদ শফি রহ. ও আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ. এর হাতেগড়া সংগঠন হেফাজত ইসলামের। ১৩ দফা দাবি নিয়ে হেফাজতের নাস্তিক্যবাদ মোকাবেলার যাত্রা শুরু। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় হেফাজত নিয়ে আলোচনা হতো তখন। আমিও তার ব্যাতিক্রম ছিলাম না। নিয়মিত খোঁজ রাখতাম। ক্লাসের ফাঁকে দৌড়ে চলে যেতাম পত্রিকা পড়তে। কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘আমার দেশ’ পত্রিকা কিনতাম। তখন ‘আমার দেশ’ পত্রিকাই একমাত্র ইসলামের পক্ষে লিখত। পত্রিকার বিশেষ পাতাগুলো সংগ্রহ করে রাখতাম। সে পাতাগুলো এখনো আছে সাক্ষী হয়ে।
দুই,
৬ই এপ্রিল ২০১৩। ঢাকা অভিমূখী লংমার্চ কর্মসূচির ঘোষণা আসলো হেফাজতের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের তৌহিদী জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিলো এই আন্দোলনে। অন্যদিকে এর দুয়েকদিন আগ থেকে হামলা মামলা ও গ্রেফতার অভিযান শুরু। বন্ধ করে দেওয়া হয় ঢাকা অভিমূখী সমস্ত যানবাহন। কিন্তু তাওহিদী জনতাকে দমিয়ে রাখা কি এতো সহজ!
দুয়েকদিন আগ থেকেই খবর পাচ্ছিলাম দূরদূরান্তের জেলাগুলো থেকে মানুষ পায়েহেটেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছে। এরপর আমার জজবা আরও বেড়ে গেল। যেকোনো মূল্যেই আমাকে যেতে হবে।
লংমার্চের আগেরদিন জুমাবার হওয়াই মাদ্রাসা থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় আসলাম। বাসার পাশেই ‘মারকাজুল কুরআন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছিলো। মাদরাসার পরিচালক মাওলানা সাকিব সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলো ‘লংমার্চে যাবা’? আমি তো এক পায়ে খাড়া! যানচলাচল বন্ধ থাকায় সিদ্ধান্ত হলো নরসিংদী থেকে নৌকা যোগে ঢাকায় পৌছাবো আমরা। আমিও জুমার পর বাসা থেকে খরচের টাকা নিয়ে মাদ্রাসায় চলে যাবার কথা বলে লংমার্চের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলাম। আমার সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্ত হয় আমার বন্ধু রাকিব। এবং আমাদেরকে সবদিক থেকে সহায়তা করলেন মারকাজুল কুরআনের ততকালীন বাবুর্চি সাইফুল ভাই। আছরের নামাজের পর নরসিংদী থানাঘাট থেকে ১টি নৌকা ছাড়ার কথা থাকলেও লোকসমাগম অনেক বেশি হওয়ায় আরো একটি নৌকা/ট্রালার ভাড়া করা হলো। দু’টো নৌকাই ছিলো কানায় কানায় ভরপুর। তিলধারণের জায়গা নেই।
সফর শুরু হলো, পথিমধ্যে আমরা একটি সবুজ চরে ইফতার ও মাগরিবের নামাজ আদায় করি।
অতঃপর অন্ধকার নেমে এলো, তবুও আমাদের নৌকা চলছে আপন গতিতে, নিজ গন্তব্য পানে।
পথিমধ্যে দুবার এক্সিডেন্টও হলো। যেহেতু আমাদেরকে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়েছে, তাই পথ চলতে কোন আলো/লাইট জালানো হয়নি। সেদিন চাঁদের আলোই আমাদের রাহাবার। রাত ২ টায় ফরিদাবাদ মাদ্রাসার পিছনে নাম না জানা কোন এক ঘাটে গিয়ে নৌকা ভিড়লো। মাদ্রাসায় পৌঁছে দেখি মাদ্রাসা ভর্তি মানুষ। মসজিদের চার তলায় আমাদের ঠাই হলো। তাহাজ্জুদ পড়ে ফজর হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম।
৬ই এপ্রিল, রোজ শনিবার বাদ ফরজ কিছু হালকা নাস্তা দেওয়া হলো। ফরিদাবাদের গেইট দিয়ে তৌহিদী জনতার স্রোত! সবার গন্তব্য শাপলা চত্বর!
আমরাও রওনা হলাম। ফরিদাবাদের প্রধান ফটক সংলগ্ন বিল্ডিং এর উপর থেকে আপেল বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমরা কিছু আপেল কুড়িয়ে নিলাম। নেমে পড়লাম ঢাকার রাজপথে। সেদিন ঢাকার অলিগলি নারায়ে তাকবীরের স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ তৌহিদী জনতা শাপলা চত্বরে গিয়ে জড়ো হয়। হেফাজতের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ দিনব্যাপী বক্তব্য দিচ্ছিলো। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলল একের পর এক অগ্নিঝরা বক্তব্য। আনন্দঘন এক পরিবেশ। ঢাকার সাধারণত মানুষ সেদিন যেভাবে আপ্যায়ন করেছেন তা কখনোই ভুলার নয়। প্রচুর পরিমান খাবার ও পানীয় বিতরণ পথেঘাটে। আমি ও আমার বন্ধু রাকিব, আমরা প্রচুর বিস্কিটের প্যাকেট কুড়িয়ে ছিলাম। বাজারের বড় ব্যাগের একব্যাগ সমপরিমান তো হবেই!
তবে সেদিন ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে খন্ড খন্ড সন্ত্রাসী হামলাও হয় তৌহিদ জনতার উপর। জনগণের অর্থে চলিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীও তাদের পেশীশক্তির প্রদর্শন করেছেন জায়গায় জায়গায়।
সবশেষে আমীরে হেফাজত আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ. এর বক্তব্য, পরবর্তী কর্মসূচি: ৫ ই মে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা ও মোনাজাতর মাধ্যমে সেদিনের মতো লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। আমরা স্লোগান দিতে দিতে কমলাপুর স্টেশনে পৌছায় এবং ট্রেনে উঠেও স্লোগান দিতে দিতে বাড়ি ফিরে আসি।
প্রথম পাঠ এখানেই সমাপ্ত। বাকিটা আগামী পোস্টে…
Jubokantho24 Ad
এ জাতীয় আরো সংবাদ
এ জাতীয় আরো সংবাদ