ফিচার প্রতিবেদন
📍 বিশেষ প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইরান অবশেষে চাললো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত চাল—হরমুজ প্রণালী বন্ধের অনুমোদন দিল পার্লামেন্ট।
বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথটিকে ঘিরে এই ঘোষণায় বৈশ্বিক অঙ্গনে চরম উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
রবিবার (২২ জুন) ইরানের পার্লামেন্ট তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদে হরমুজ প্রণালী বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। এই প্রস্তাব এখন দেশটির সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদ—সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল-এর চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। অনুমোদন মিললেই কার্যকর হবে সেই প্রণালিবন্ধ।
মানচিত্রে দেখলে দেখা যায়, হরমুজ প্রণালী পারস্য উপসাগরকে সংযুক্ত করে ওমান উপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সঙ্গে। এটি ইরান ও ওমানের মাঝখানে অবস্থিত মাত্র ৩৯ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি সংকীর্ণ সমুদ্রপথ, তবে এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম।
বিশ্বে ব্যবহৃত মোট তেলের ২০ শতাংশের বেশি এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (LNG) প্রায় এক-পঞ্চমাংশ প্রতিদিন এই পথ দিয়েই রপ্তানি হয়। অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল এবং বিপুল গ্যাস প্রতিদিন হরমুজ হয়ে পৌঁছে যায় এশিয়া, ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলে।
এই প্রণালির কোনো কার্যকর বিকল্প না থাকায় এর ওপর নির্ভরতা সর্বোচ্চ। সৌদি আরব বা কাতারের কিছু আংশিক বিকল্প থাকলেও তা মাত্র ৪০ শতাংশ সরবরাহ সক্ষম, যেখানে বাকি ৬০ শতাংশ কার্যত এই প্রণালির উপরেই নির্ভরশীল। এটি বিশ্বের একমাত্র এমন রুট, যেখানে ভারি ট্যাংকারগুলো নিরাপদে চলাচল করতে পারে।
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়া মানে তেলের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া, শিল্প উৎপাদনে ধাক্কা, খাদ্য পরিবহন ও পণ্য আমদানি-রপ্তানির খরচ বেড়ে যাওয়া।
বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া—তাদের জ্বালানির ৮৪ শতাংশ এই পথেই আসে। ফলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো গ্লোবাল সাউথের অর্থনীতিতে নেতিবাচক ঢেউ বয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলোর ক্ষেত্রে চিত্র আরও ভয়াবহ। দেশের ৯০ শতাংশ জ্বালানি আমদানি-নির্ভর, যার বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ফলে হরমুজ বন্ধ হলে
হ্যাঁ, হরমুজ বন্ধ করা ইরানের একটি ‘উচ্চঝুঁকিপূর্ণ’ সিদ্ধান্তও বটে।
অতএব, চীনও হয়তো চাপে ফেলবে ইরানকে এই পদক্ষেপ পুনর্বিবেচনার জন্য।
হরমুজ পুরোপুরি বন্ধ করা ইরানের জন্য যেমন একপ্রকার ‘আত্মঘাতী’, তেমনি কৌশলগত চাপ সৃষ্টির একটি কার্যকর হাতিয়ারও।
তেহরান হয়তো আংশিক সময়ের জন্য প্রণালী বন্ধ রেখে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চাপ সৃষ্টি করতে চায়। এমনটা ঘটছে বলেই মনে হচ্ছে—কারণ ইতোমধ্যেই জিপিএস বিভ্রাটে প্রায় ৯৭০টি জাহাজ পথ হারিয়েছে, যার পেছনে ইরানের সাইবার কার্যকলাপের ইঙ্গিত মিলছে।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে তেহরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে।
একটি সংকীর্ণ জলপথ আজ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, বিশ্বের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক ভারসাম্যের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে।
✍️ মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া
লেখক— দি অ্যানাটমি অব ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স, দি কসমিক প্লে অব কন্টেমপোরারি গ্লোবাল পলিটিক্স