বৃহস্পতিবার, ০৮ Jun ২০২৩, ০১:০১ পূর্বাহ্ন
যুবকণ্ঠ ডেস্ক:
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে এখন যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে নির্দিষ্ট সুদহারে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ ব্যাংকগুলোর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানত ও ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা শুরু হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন—এই মুহূর্তে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা উঠিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুযায়ী সুদহারের এক অঙ্কের (৯ শতাংশ) নির্দেশনা তুলে দিতে চায় না বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় মনে করেন, এখন সুদহারের এক অঙ্কের (৯ শতাংশ) নির্দেশনা তুলে দিলে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি বিঘ্নিত হবে সরবরাহ।
অবশ্য গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে (বিআইবিএম) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মুহূর্তে লেন্ডিং ক্যাপ উঠানোর বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসবে না।
কারণ, এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বই এখন চ্যালেঞ্জের মধ্যে। এই অবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা উঠিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
তবে আইএমএফ যদি সরকারের এ অবস্থানে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে বাংলাদেশ আইএমএফের রেজিলিয়ান্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ট্রাস্ট (আরএসএফটি) তহবিল থেকে ১৫০ কোটি ডলার ঋণ চাইবে। এই তহবিল থেকে ঋণের ব্যাপারে আইএমএফ কঠিন কোনও শর্ত দেয় না। এই ঋণের মেয়াদ হবে ২০ বছর। গ্রেস পিরিয়ড থাকবে ১০ বছর।
গত জুলাই মাসে আইএমএফের এশীয় প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের বিভাগীয় প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি দল ঢাকা সফর করেছে। সফরকারী দলটি ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব খাতে সংস্কার, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা, বেঁধে দেওয়া ঋণের সুদের হার তুলে দেওয়াসহ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে গেছে। যদিও ব্যাংকের চলমান সুদের হার (৬ থেকে ৯ শতাংশ) তুলে দেওয়ার এই শর্তের ব্যাপারে একমত নয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, সুদহার বাড়ালে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। সুদহার সহনীয় থাকায় করোনার পর দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দায়ও বেঁধে দেওয়া সুদহার ভূমিকা রাখবে বলে আশা সরকারের।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণ ও বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সুদের হারে এক অঙ্ক কার্যকর করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বছরের ১ এপ্রিল থেকে তা কার্যকর করা হয়।
এদিকে তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১১ বার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবার ঋণের ক্ষেত্রেই আইএমএফ কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে—এবারও আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পেতে সরকারকে বেশ কিছু শর্ত মানতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পেতে হলে সবসময়ই তাদের বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। আইএমএফ সবসময় চায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভালো হোক, যাতে ঋণ গ্রহণকারী দেশ ঋণ পরিশোধ করতে পারে। সে জন্যই তারা শর্ত দেয়।
আগামী ১০ থেকে ১৬ অক্টোবর আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলন হবে যুক্তরাষ্ট্রে। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করবে আইএমএফ। অবশ্য এরইমধ্যে আইএমএফ কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য শর্ত পূরণের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে।
জানা গেছে, ঋণ পাওয়ার জন্য অর্থনীতির বর্তমান চিত্র বিশদভাবে সম্মেলনের সময় অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সংস্থাটিকে তখন অনুরোধ করা হবে সম্মেলন শেষেই যেন ঋণের আলোচনা শুরু করতে তাদের একটি মিশন বাংলাদেশ সফরে আসে।
ওয়াশিংটনে আলোচনা সফল হলেই সংস্থাটির মিশন আসবে বাংলাদেশ সফরে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে আইএমএফের জন্য একটি লেটার অব ইনটেন্ড বা ইচ্ছাপত্র তৈরি করা হবে। এতে কোন পরিস্থিতিতে সরকার ঋণ নিতে চায় এবং কী কী শর্ত পূরণ করতে চায়, তা বলা থাকবে। ইচ্ছাপত্রটি আইএমএফের পর্ষদে উঠবে। পর্ষদ অনুমোদন করলে মিলবে কাঙ্ক্ষিত ঋণ।
জানা গেছে, আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রথম ঋণ নিয়েছিল ১৯৭৪ সালে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল—এই ১০ বছরে বেশিবার ঋণ চাওয়া হয়েছে। এ সময়ে পাঁচবার ঋণ দিয়েছে আইএমএফ। প্রতিবারই ঋণ নিতে শর্ত পূরণ করতে হয়েছে।
১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ১১ বছর বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে কোনও ঋণ নেয়নি। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ আবার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়। সেবার বড় শর্ত ছিল, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনতে হবে। আইএমএফের সেই শর্ত মেনে আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল তখনকার সরকার।
সর্বশেষ ২০১২ সালে আইএমএফের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল সরকার। সে সময় করনীতির কিছু সংস্কারের শর্ত দিয়েছিল সংস্থাটি। নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন ও কার্যকর এরই অংশ।