বৃহস্পতিবার, ০৮ Jun ২০২৩, ০২:০৯ পূর্বাহ্ন
মুনশী নাঈম:
২০২৩ সাল থেকে সারাদেশে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রথম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে স্কুল ও মাদরাসায় অভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে পাঠদান শুরু হচ্ছে। মাদরাসার শিক্ষকরা বলছেন, এসব পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয় এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের বিশ্বাস, আদর্শ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে, বিশেষত মাদরাসা শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। তারা শিক্ষামন্ত্রণালয়ে দেয়া স্মারকলিপিতে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোও তুলে ধরেছেন। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর সর্বশেষ দাবি হলো, মাদরাসা শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ সাপেক্ষে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোর সমাধান করেই নতুন পাঠ্যপুস্তক ছাপা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদরাসার শিক্ষকরা যখন নতুন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আপত্তি তুলেন, শিক্ষামন্ত্রী নতুন করে পাঠ্যপুস্তক রিভিশন দেয়ার নির্দেশনা দেন কর্মকর্তাদের। এবং আপত্তি নিরসন করারও পরামর্শ দেন।
দায় নিবে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড?
নতুন পাঠ্যপুস্তকে ইসলামবিরোধী কন্টেন্ট বিষয়ে দায় নিতে চায় না বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রকাশনা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী ফাতেহকে বলেন, ‘বিষয়টি দেখার কথা এনসিটিবির। মাদরাসার বইপুস্তক এখন মাদরাসা বোর্ড তৈরী করে না। তৈরী করে এনসিটিবি। ২০১৮ সালে এনসিটিবির যে আইন তৈরী হয়, তাতে বলা হয়, এনসিটিবি স্কুল এবং মাদরাসা উভয় ধারার শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করবে। এরপর ২০২০ সালে যে মাদরাসা আইন হয়, তাতে বলা হয়, মাদরাসা বোর্ড এনসিটিবিকে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সাহায্য করবে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব এনসিটিবিকে সাহায্য করি।’
মাদরাসার পাঠ্যপুস্তকে ইসলামবিরোধী কন্টেন্ট বিষয়ে দায় এনসিটিবির হলেও মাদরাসা বোর্ডের দায়িত্ব কী? প্রশ্নের উত্তরে ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের তো সাহায্য করার কথা। তাই করছি যতটুকু পারছি। তবে মাদরাসা শিক্ষকরা নতুন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যে আপত্তি তুলেছেন, সেগুলো আমাদের নলেজে আছে। শিক্ষামন্ত্রী নতুন করে রিভিশন দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের সমস্যা নিরসন করার নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে সে নির্দেশনা মেনে পরিবর্তন করেই পাঠ্যপুস্তক ছাপা হচ্ছে কিনা, জানি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু স্কুল-মাদরাসায় একই বই পড়ানো হবে, এনসিটিবির দায়িত্ব হলো এমনভাবে বই রচনা করা, যেন সর্বমহলে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। এটা কঠিন কাজ। কিন্তু কঠিন বলে বসে থাকলে চলবে না। এই কঠিন কাজটিই সমাধান করতে হবে। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, মাদরাসার জন্য আলাদা কারিকুলাম হওয়া উচিত। এনসিটিবি সে কাজ শুরুও করেছিল। হয়তো সময়ের কারণে হয়ে উঠেনি।’
তবে ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘২০২৩ সালে যে বইগুলো দেয়া হচ্ছে, তা পরিক্ষামূলক। এই বইগুলোর উপর মতামত এলে সে অনুযায়ী বইগুলো আবার পরিমার্জন করা হবে।’
এনসিটিবি কী বলছে?
আলেমদের আপত্তি নিরসন করে নতুন পাঠ্যপুস্তক ছাপা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলাম জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর গবেষণা কর্মকর্তা উম্মে কুলসুমের কাছে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী আপত্তি নিরসন করে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আপত্তি নিরসন করেই ছাপা হচ্ছে কিনা, তা অমি জানি না। ভালো হয় প্রফেসর মোঃ মশিউজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আপনাকে সঠিক তথ্য দিতে পারবেন।’
এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর শিক্ষাক্রম উইংয়ের সদস্য প্রফেসর মোঃ মশিউজ্জামানের সঙ্গে। আলেমদের আপত্তি নিরসন করে নতুন পাঠ্যপুস্তক ছাপা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আলেমদের আপত্তি আমলে নিয়ে আপত্তি নিরসন করেই নতুন বই ছাপানো হচ্ছে। আমরা মাদরাসার শিক্ষকদের সঙ্গে বসে মিটিং করেছি। শিক্ষামন্ত্রীও ছিলেন সে মিটিংয়ে। আলেমদের পরামর্শ মোতাবেক পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করেছি। তবে বইগুলো ২০২৩ সালে চলবে পরীক্ষামূলক। বইগুলো প্রকাশের পর যদি; নতুন কোনো সমস্যা ধরা পড়ে, মতামত জানায়, তাহলে আমরা আবার পরিবর্তন করবো।’
উল্লেখ্য, শিক্ষকরা বলছেন, এসব পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত অধিকাংশ ছবি, চিত্র, শব্দ, বাক্য, তথ্য ও উপাত্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মর্মাহত এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা নিয়ে সঙ্কিত করে তুলবে। যেমন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ৯টি বইয়ের মধ্যে কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইত, মুসলিম মনীষী, বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিকদের বাণী, উদ্ধৃতি, নীতি-নৈতিকতা সৃষ্টিকারী কোন বিষয় স্থান পায়নি। উপরন্ত আপত্তিজনক বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন বিজ্ঞান বইয়ে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি দিয়ে তাদের লজ্জাস্থানের পরিচয় দেয়া হয়েছে। ৯টি বইয়ে শতশত মেয়ের বেপর্দা ছবি ছাপানো হয়েছে। হিন্দু মহিলার শাঁখা পরা ছবি রয়েছে। ইংরেজি বইয়ে কুকুর ও নেকড়ে বাঘের ২৪টি ছবি ছাপানো হয়েছে, যা ইউরোপীয় সংস্কৃতির অংশ বিশেষ।
তারা আরও বলছেন, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ (মানুষ সৃষ্টি হয়েছে বানর থেকে), দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি এবং দেবতাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। জীবন জীবিকা বইয়ে ইশপের গল্প, প্রণাম, গানশোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পাশ্চাত্য ও মূর্তিপূজার সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও দূর্গাপুজা, গীতাঞ্জলী, কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বইগুলোতে মানুষের যেসব নাম ব্যবহৃত হয়েছে, একটি মুসলিম দেশে তা সত্যিই আপত্তিকর। যেমন: আনিকা, লিটল, রাড, প্লাবন, রতন, দীপক, নন্দিনী, এন্তি, মিসেল, মনিকা চাকমা, ডেবিট, প্রিয়াঙ্কা, মন্দিরা ইত্যাদি। সামগ্রিক বিবেচনায় ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে পাশ্চাত্য, দেব-দেবীর বিশ্বাস ও তাদের আরাধনার শিক্ষা-সংস্কৃতির আদলে তৈরি বইগুলো স্কুলের জন্যও উপযোগী নয়।