সোমবার, ০৫ Jun ২০২৩, ০৭:৫০ অপরাহ্ন
ড. মো: কামরুজ্জামান
বর্তমান বাস্তবতা হলো, আলেমরা আর্থ-সামাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে। এটি নতুন নয়, ব্রিটিশ আমলে আমাদের আলেম সমাজকে আর্থ-সামাজিকভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে আমরা দু’বার দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু আলেমদের সে অবস্থার কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। ফলে তাদের বড় একটি অংশ নিজেদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন। সামাজিক কার্যক্রমেও তাদের অন্তর্ভুক্তি খুবই কম।
কওমি মাদরাসায় পড়–য়াদের বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য হচ্ছে মসজিদের ইমাম ও কওমি মাদরাসার শিক্ষক হওয়া। জাগতিক ব্যাপারে উচ্চতর আকাক্সক্ষা তাদের খুবই কম। এ কারণে এ বিষয়ে তাদের মানসিকতাও দুর্বল। এ কারণে তাদের মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য বড় কিছু করার সঙ্কল্প সৃষ্টি হয় না। জাতীয় পর্যায়ে দেশের সেবা কার্যক্রমে তাদের অংশীদারিত্ব নেই বললেই চলে। আর আলিয়া মাদরাসায় যারা অধ্যয়ন করেন তাদের উদ্দেশ্য বড় হলেও বর্তমান বাস্তবতা তাদের জন্য খুবই প্রতিকূল। তাদের গন্তব্য অনেক দূরের হলেও তারা বেশি দূর যেতে পারে না। ব্রিটিশ আমলের মতো তারা আজ সামাজিকভাবে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। যদিও নিকট অতীতে তাদের মধ্যে অনেকে জাতীয়ভাবে দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে দেশের সেবায় নিয়োজিত ছিল বা এখনো আছে। কিন্তু বর্তমানে আলিয়া মাদরাসা ও কলেজের প্রভাষক, স্কুল কিংবা মাদরাসার সহকারী মৌলভি শিক্ষক ও বিয়ের কাজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মধ্যেই তাদের গন্তব্য সীমাবদ্ধ। উভয় মাদরাসা ব্যবস্থা দু’ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। এ দুটো সমস্যাই আলেমদের যথার্থ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় ও সমস্যা। আলেম সমাজের আরেকটি সমস্যা হলো, তাদেরই মধ্য থেকে একটি ক্ষুদ্র অংশের ইসলামবিরোধী শক্তির পক্ষে ক্রীড়নকের ভ‚মিকা পালন করা। এ শক্তিটি ক্ষুদ্র হলেও ইসলামবিরোধীদের কাছে এটি অনেক বড় হাতিয়ার। তারা তাদের দলীয় প্রচার প্রচারণায় আলেমদের এ ক্ষুদ্র শক্তিটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। এ শ্রেণীর আলেমরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। শরিয়ত ও মারিফতের অপব্যাখ্যা করে এবং শিরক ও বিদয়াতসহ নানা অনাচার ও অপতৎপরতায় লিপ্ত।
আমাদের দেশের বেশির ভাগ আলেম ও পীর-মাশায়েখ ইসলামের অনেক মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। অথচ মৌলিক ও বড় বিষয়গুলো এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, এগুলোর প্রতি উদাসীনতা উম্মাহর অস্তিত্ব ও সামগ্রিক সত্তাকে বিপন্ন করে। এক শ্রেণীর আলেম সুন্নি-ওহাবি বিবাদ, দেওবন্দী-ব্রেলভি ঝগড়া, মাজহাবি-লামাজহাবি বিরোধ আরো চাঙা করে তুলছেন। নবীজী সা: আগুন না মাটির তৈরি, দাড়ি রাখা ও এর পরিমাপ, জামার মাপ, পাগড়ির প্যাঁচ, ‘আমীন’ জোরে বা আস্তে বলা, তাশাহুদের সময় আঙুল নাড়ানো, কিয়াম করা না করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা অবিরাম মেতে আছেন। এমন এক সময়ে এসব বিষয়ে হইচই করা হচ্ছে যখন মুসলিম উম্মাহ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজতন্ত্র, ইহুদিবাদ ও খ্রিষ্টবাদের বৈরিতার নিচে পিষ্ঠ। পৃথিবীজুড়ে এসব মতবাদের অনুসারীরা মুসলিমদের হত্যা করছে, নিশ্চিহ্ন করছে। মুসলিম দায়িরা চরম ভীতি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দেশ ও মহাদেশ থেকে প্রকাশ্যে মুসলিম উচ্ছেদের ঘোষণা আসছে। মুসলিমদের ওপর এ নির্যাতনের মূল কারণ হলো নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, আত্মকলহ আর ঝগড়া।
আলেমদের ঝগড়া-বিবাদের কারণে অতীতে মুসলিম জাতির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগ নেমে আসার ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, উজবেকিস্তানের ঐতিহাসিক প্রধান ধর্মীয় শহর ছিল সমরকন্দ ও বুখারা। যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন ইমাম বুখারি রহ:সহ অনেক মুসলিম পণ্ডিত। এখানে বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতাদের মধ্যে পাগড়ির প্যাঁচ আর টুপির আকৃতি নিয়ে দীর্ঘ সংঘর্ষ হয়েছিল। পাগড়িতে কত প্যাঁচ হবে আর টুপির আকার কেমন হবে; এটি ছিল সংঘর্ষের মূল কারণ! খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে এ ঝগড়ার শেষ পরিণতি হিসেবে তাশখন্দ, কাশগড়, তিরমিজ, সমরকন্দ ও বোখারায় নেমে এসেছিল নাস্তিক্যবাদী শাসন। অথচ এ অঞ্চলগুলো ছিল তৎকালীন ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। নাস্তিক্যবাদী শাসনের ফলাফল কী হয়েছিল বর্তমান যুগের আলেমরা মনে হয় ভুলে গেছেন। আর মনে থাকলেও সম্ভবত তারা ব্যক্তি স্বার্থের কাছে ইসলামের শিক্ষার কবর রচনা করেছেন। নফসের দাসত্বের জিঞ্জিরে তারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তাদেরকে নতুন করে মনে করিয়ে দিতে চাই- তাশখন্দ, কাশগড়, তিরমিজ, সমরকন্দ ও বোখারার মুসলিমদের করুণ আর্তনাদের কথা। ধর্মহীন নাস্তিক্যবাদী শাসন আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল কুরআন, হাদিসসহ সব ইসলামী পুস্তক ও লাইব্রেরি। তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ঐতিহাসিক সব মাদরাসা ও মসজিদ। হত্যা করেছিল দুই পক্ষের লাখ লাখ আলেমকে। ধর্মহীন এ শাসন দীর্ঘ হয়েছিল প্রায় পৌনে এক শতাব্দীকাল। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল এ শাসন ইমাম বোখারির দেশে। ওইসব এলাকার বর্তমান বাস্তবতা হলো, সেখানে এখন আর নাস্তিক্যবাদী শাসন নেই। ধর্মহীন শাসনের অবসান হয়েছে কিন্তু আজো সেখানে নামাজ, রোজা, হিজাব ও আরবি বর্ণমালা নিষিদ্ধ। ঘোষণা দিয়ে বিকৃত করা হচ্ছে পবিত্র আল-কুরআন। প্রায় অর্ধকোটি মুসলিম ও নারীকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে বন্দী। নারীদের ওপর চলছে পৈশাচিক গণধর্ষণ, চলছে জোরপূর্বক গর্ভপাত। কিন্তু বাংলার আলেম সমাজের ঝগড়া ও ফতোয়াবাজি এতটুকুও কমেনি। তাদের চোখ খোলেনি। জাগ্রত হয়নি তাদের মধ্যে ন্যূনতম সহনশীলতা, ধৈর্য, ভদ্রতা আর বিবেকবোধ।
অনৈক্যের কারণে বর্তমান মুসলিম বিশ্ব আজ এক দিশেহারা অথর্ব জাতিতে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিন তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ফিলিস্তিন ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত নবীদের পুণ্য জন্মভ‚মি। ইতিহাসখ্যাত যাযাবর ইহুদিরা মুসলিমদের এ পুণ্যভূমিটিকে জোর করে দখলে নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করেছে। মাত্র ৮৬ লাখ ইহুদি ২৫টি আরব রাষ্ট্রের ৩৫ কোটি মুসলমানকে ভেড়ায় পরিণত করেছে। এর একমাত্র কারণ মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য। নবীদের উত্তরসূরিখ্যাত আলেমরা ঐক্যের জন্য গলা ফাটিয়ে ওয়াজ করেন, কুরআন-হাদিসের রেফারেন্সও প্রকাশ করেন কিন্তু তাদের মধ্যে ঐক্যের ছিটেফোঁটাও নেই। বর্তমান বিশ্বে ধর্মহীন সব গোষ্ঠী মুসলিমদেরকে দমিয়ে রাখতে ঐক্যবদ্ধ। লক্ষ্য অর্জনে তারা টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, নারী ও মেধা প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের আলেমদের দায়িত্ব হলো ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও একে অপরকে সম্মান দেয়া।
দেশে তিন শ্রেণীর আলেম ও দলকে নিরবচ্ছিন্ন দাওয়াহ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দেখা যায়। এ তিনটি গ্রæপ হলো- ক. দেওবন্দী; খ. আহলে হাদিস ও গ. জামায়াতে ইসলামী। দেওবন্দী গ্রুপটি নিম্নোক্ত ১৩টি উপদলে বিভক্ত। এ ১৩টি উপদল হলো- ১. তাবলিগ জামাত (দেওবন্দপন্থী); ২. তাবলিগ জামাত (সাদ কান্দলভিপন্থী); ৩. ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই); ৪. জমিয়তে ইসলাম (ওয়াক্কাস); ৫. জমিয়তে ইসলাম (নূর হোসেন); ৬. খেলাফত আন্দোলন; ৭. খেলাফত মজলিস; ৮. ইসলামী ঐক্যজোট (আজিজুল হক); ৯. ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনি); ১০. ইসলামী ঐক্যজোট (মেসবাহুর রহমান); ১১. ইসলামী ঐক্যজোট (ইজহারুল ইসলাম); ১২. নেজামে ইসলাম ও ১৩. হেফাজতে ইসলাম।
এ কয়টি উপদলের সবগুলোই কওমি ধারার প্ল্যাটফর্ম। বেশির ভাগ কওমি আলেম ও শিক্ষার্থী তাদের মুরব্বিদের অন্ধভাবে অনুসরণ করেন বিধায় কুরআন হাদিসের ওপর মুরব্বিদের কথাই বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এ প্ল্যাটফর্মে এমন অনেকেই আছেন যারা ঠুনকো কোনো বিষয় নিয়ে আমিরকে অমান্য করেন। অনেকে এমন আছেন, নিজেকে আমির ঘোষণা করে মূল দল থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্ন দল খাড়া করেছেন।
আহলে হাদিস উপমহাদেশে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৪৬ সালে। বর্তমানে এটি ১৫টি উপদলে বিভক্ত- ১. জমিয়তে আহলে হাদিস; ২. শুরাবায়ে আহলে হাদিস; ৩. আহলে হাদিস আন্দোলন (গালিব); ৪. আহলে হাদিস আন্দোলন (আ: রাজ্জাক); ৫. আহলে হাদিস তাবলিগে ইসলাম; ৬. জমিয়তে শুব্বানে আহলে হাদিস; ৭. আহলে হাদিস যুব সংঘ (মুজাফফর); ৮. মাদখালে আহলে হাদিস (আকরামুজ্জামান); ৯. অল ইন্ডিয়া আহলে হাদিস; ১০. আঞ্জুমানে আহলে হাদিস; ১১. বঙ্গ ও আসাম জমিয়তে আহলে হাদিস; ১২. ট্র্রু সালাফি আহলে হাদিস; ১৩. কুতুবি সালাফি আহলে হাদিস; ১৪. সুরুলি সালাফি আহলে হাদিস ও ১৫. জামিয়াহ আহলে হাদিস।
তিন শ্রেণীর মধ্যে তৃতীয় দলটি হলো জামায়াতে ইসলামী। দলটি ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠা পেলেও এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনো উপদল সৃষ্টি হয়নি। দলটিতে আলেমের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সাধারণ শিক্ষিতদের সমন্বয় ঘটেছে।
এ তিন গ্রুপের বাইরে আরো দু’টি গ্রুপ রয়েছে। একটি হলো ব্রেলভি গ্রুপ, অন্যটি জঙ্গি গ্রুপ। এর মধ্যে ব্রেলভি গ্রুপ ইসলাম নিয়ে বেশ কিছু কাজ করলেও উল্লিখিত তিন শ্রেণীর আলেম তাদেরকে সঠিক ইসলামী দল বলে মনে করেন না। ব্রেলভি গ্রুপটি ১৬টি উপদলে বিভক্ত- ১. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত (চট্টগ্রাম); ২. ফুলতলী (সিলেট); ৩. দেওয়ানবাগী; ৪. রাজারবাগী; ৫. ফুলেশ্বরী; ৬. সুরেশ্বরী; ৭. চন্দ্রপুরী; ৮. এনায়েতপুরী; ৯. আটরশী; ১০. মাইজভাণ্ডারী; ১১. ইসলামিক ফ্রন্ট (মতিন); ১২. ইসলামিক ফ্রন্ট (জুবাইর); ১৩. দাওয়াতুল ইসলাম; ১৪. মুনিরিয়া তাবলিগ কমিটি; ১৫. তরিকত ফেডারেশন ও ১৫. গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ। এসব দলের কর্মীরা সামান্য কারণেই ভিন্ন মতের মানুষদের কাফির বলে ফতোয়া দিয়ে থাকেন।
সর্বশেষ গ্রুপটিকে জঙ্গি গ্রুপ বলা হয়ে থাকে। সর্বসম্মতিক্রমে এরা ইসলামবিরোধী গ্রুপ। এরা বর্তমানে ছয়টি উপদলে বিভক্ত- ১. জেএমবি; ২. আনসারুল্লাহ বাংলা টিম; ৩. হেজবুত তাহরিক; ৪. হেজবুত তাওহিদ; ৫. হরকাতুল জিহাদ ও ৬. আইএস।
উপরের আলোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে ইসলামের নামে দেশে মোট ৪৯টি দল ও উপদল রয়েছে। তবে এ গণনার বাইরেও ইসলামের নামে কিছু দরবার ও দল আছে। ফুরফুরা ও ছারছিনা গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দরবার। এসব দলের আলেমরা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে নানা দল ও উপদলে বিভক্ত। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো মুসলিমরা দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং খুঁটিনাটি বিষয় এড়িয়ে চলবে। আর যখনই মুসলিমরা মৌলিক লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে, তখনই তাদের মধ্যে অনিবার্যভাবে দল-উপদলের সৃষ্টি হবে। যা ইতঃপূর্বে বিভিন্ন নবীর উম্মতের মধ্যে দেখা দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যেন তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হিদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে’ (সূরা আলে ইমরান-১০৫)।
এখানে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের এমন সব উম্মতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা সত্য দ্বীনের সুস্পষ্ট শিক্ষালাভ করেছিল। কিন্তু কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়াবলি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়েছিল। নিজেদেরকে একটি আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। এরপর অবান্তর বিষয় নিয়ে তারা কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তারা ভুলে গিয়েছিল। বিশ্বাস ও নৈতিকতার যেসব মূলনীতির ওপর তাদের সাফল্য নিশ্চিত ছিল, তার প্রতি তাদের আর কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না। আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না, তাহলে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়ে যাবে। ধৈর্যের পথ অবলম্বন করো, অবশ্যই আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন’ (সূরা আনফাল-৪৬)।
বাংলাদেশের আলেমদের বর্তমানে বড় দুর্দিন যাচ্ছে। আলেমদের অনৈক্যের কারণে একটি বেসরকারি গণকমিশন ১১৬ জন আলেমকে কালো তালিকাভুক্ত করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। তাদের অনৈক্যের কারণে অনেক নিরীহ আলেম জেলখানায় মানবেতর জীবন পার করছেন। দেশের শিক্ষানীতিতে ইসলামী শিক্ষার বিলুপ্তি ঘটেছে। কলেজে ইসলামী শিক্ষা একটি ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আলিয়া মাদরাসা থেকে আরবি ও ইসলামী শিক্ষা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামী শিক্ষা বিদায় নিয়েছে। এত কিছুর পরও আলেমরা তাদের ফতোয়াবাজি অব্যাহত রেখেছেন!
এমতাবস্থায় আলেমদের কাছে আমাদের ও দেশবাসীর দাবি হলো, আপনারা কুরআনে উল্লিখিত নির্দেশনা সামনে রেখে একটি শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করুন। সব দলের সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসুন। এ বিষয়ে আন্তরিকতার সাথে সব দলের সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে একটি ফতোয়া বোর্ড গঠন করুন। সব দলের তারকা বক্তাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করুন। অরাজনৈতিক বরেণ্য আলেমদেরও কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করুন। ফতোয়া দিতে শুধু গঠিত এ ফতোয়া বোর্ডকেই দায়িত্ব দিন। বক্তৃতা ও ওয়াজের মঞ্চটিকে পরিচ্ছন্ন রাখুন। জনমানুষের অন্তরে সৃষ্ট বিরক্তি দূর করার ব্যবস্থা করুন। আলেম ও ইসলাম সম্পর্কে জনমনে সৃষ্ট নেতিবাচক ধারণা দূর করুন। কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত ফতোয়া বোর্ডের এ শাখা জেলা ও থানা পর্যায়ে বিস্তৃত করুন। কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী ভিন্নমতের মানুষদের সম্মান করুন। ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিবেশ তৈরি করুন। মুস্তাহাব ও মুস্তাহসান নিয়ে যুগ যুগ ধরে আলেমদের মধ্যে চলে আসা মতভেদ বন্ধ করুন।
আপনারা নবীদের উত্তরাধিকার, আপনারাই জাতির অভিভাবক। কিন্তু আপনাদের নির্লিপ্ততা আর ঝগড়া বাংলার আকাশে আজ জন্ম নিয়েছে কালো মেঘ। বাংলা থেকে চির বিদায় নিতে বসেছে সত্য দ্বীন ও দ্বীনের আলো।
লেখক : অধ্যাপক, দাওয়াহ অ্যান্ড ইমলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
Email: dr.knzaman&gmail.com