রবিবার, ০৪ Jun ২০২৩, ০২:৫৯ পূর্বাহ্ন
এক সময়কার মসজিদের নগরী ঢাকা এখন মাদরাসারও নগরী। আগে মফস্বলের ইলমপিপাসুদের স্রোত ছিল চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পটিয়া, নানুপুর, নাজিরহাটের দিকে। এখন সে স্রোতের একটি বৃহৎধারা ঢাকার দিকে বহমান। ঢাকা এখন বাংলাদেশের প্রশাসনিক রাজধানীর মতো ইলমের রাজধানী হতে চলেছে। বিশেষকরে উচ্চতর ইলম ও শিক্ষাদীক্ষার জন্য তালিবে ইলমগণ এখন ঢাকামুখী। ঢাকায় নানাবিষয়ে বিপুলপরিমাণ তাখাসসুসের মারকায প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ছাত্রদের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ। যদিও সবগুলো তাখাস্সুসকে মানসম্পন্ন বলা মুশকিল। তথাপি ছাত্ররা ঢাকা যাচ্ছে, ঢাকায় পড়ছে, ঢাকামুখি হয়ে পড়ছে, সেটাই বাস্তবতা।
আমার কিছু পরিচিত তালিবে ইলমও বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় পড়তে গেছেন। ভর্তির জন্য বিভিন্ন মাদরাসায় ছুটোছুটি করেছেন। এসব মাদরাসার ভর্তিব্যবস্থাপনার ভোক্তভোগী তারা। তাদের মাধ্যমে ঢাকার মাদরাসাগুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে নানান তথ্য-উপাত্ত আমি সংগ্রহ করেছি। এতদভিন্ন কোনো কোনো মাদরাসার ভর্তি প্রক্রিয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সবমিলিয়ে আমার মধ্যে একধরণের মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে এবং কিছু সমস্যা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, ভর্তিব্যবস্থায় সামান্য পরিবর্তন ও সংস্কার আনলে বিষয়টি আরও সুন্দর ও হতে পারে এবং ভর্তিচ্ছুক তালিবে ইলমদের জন্য অনেক সুবিধা হতে পারে। ঢাকায় অধ্যয়নরত একজন তালিবে ইলমের অনুরোধে সে মিশ্র-অনুভূতি এবং কিছু কথা পাঠকদের খেদমতে পেশ করছি। তবে কিছু তিক্ত কথা বলার জন্য অগ্রিম দুঃখ প্রকাশ করছি।
১) আগে আমরা ঢাকার নামীদামী কলেজ-ভার্সিটিগুলোতে ভর্তিযুদ্ধের কথা শুনেছি। প্রতিযোগিতামূলক ভর্তির একটি ধারা এখনো জেনারেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, সুখের সংবাদ হলো- কাওমীমাদরাসার শিক্ষাক্রমের উন্নতির সুবোদে আমাদের নামী দামী মাদরাসাগুলোতেও এখন প্রতিযোগিতামূলক ভর্তির ধারা চালু হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার মান ভালো, সেখানে ছাত্ররা ভর্তির জন্য রীতিমত যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এটা কাওমী মাদরাসার শিক্ষাব্যস্থার জন্য সুসংবাদ। আল্লাহ তাআলা এতে আরও উন্নতি দান করুন।
২) এ নেয়ামতের শুকরিয়া হবে, এর যথাযথ কদর করা। তালিবে ইলমের মূল্যায়ন করা। তাদের আগমনকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা। তাদের ভর্তি থেকে শুরু করে পড়ালেখা, থাকা খাওয়া, তা’লীম তারবিয়াতের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩) ঢাকায় আগত ছাত্ররা বেশিরভাগই দূরগ্রাম ও মফস্বল থেকে আগত। এসব দূরাগত ও নবাগত ছাত্ররা ঢাকায় এসে নানা বিড়ম্বনায় পড়ে। তাদেরকে ইস্তিকবাল করা, সুন্দর অভ্যর্থনা ও গুড রিসিপশন করার যথেষ্ট অভাবের কথা প্রায় শোনা যায়। তাদের গুরুত্ব দিয়ে, তাদের আগমনের আনন্দ প্রকাশ করে এবং তাদের হাসিমুখে বরণ করা হয় না অনেক মাদরাসায়। কোনো কোনো মাদরাসার কর্তৃপক্ষের ভাবখানা এমন বলে শোনা গেছে, “আমাদের মাদরাসা অনেক বড়। কত ছাত্রই তো এখানে আসবে। এদের এত মূল্যায়নের কি আছে?”
৪) ভর্তিচ্ছুক ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে একই সময়ে একাধিক মাদরাসার ভর্তি পরীক্ষার কারণে। দেখা যায়, সীমিত কোটায় ভর্তি পরীক্ষার জন্য কয়েকগুণ বেশি ছাত্র পরীক্ষা দিচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকজন নেওয়ার পর বাকীরা অন্যান্য ভালো মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করে শুধুমাত্র অভিন্ন সময়ে ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার কারণে। যদি বড় মাদরাসারগুলো একটু আগ-পর করে ভর্তিপরীক্ষা গ্রহণ করে, তা হলে তালিবে ইলমদের অনেক সুবিধা হতো। এক্ষেত্রে মারকাযুদ্দাওয়াহ কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। বিগত কয়েকবছর থেকে তাঁরা রমাযানেই ভর্তিকার্যক্রম শেষ করছেন।
৫) ইস্তিবাল, অভ্যর্থনা ও দিকনির্দেশনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবগত ছাত্ররা এক্ষেত্রে বহু কষ্ট পোহাতে হয়। যদি মাদরাসাগেইটে পুরোনো তালিবে ইলমদের দিয়ে, অথবা খাদেম বা স্টাফ নিয়োগ করে ইলমে নববীর এসব তালিবে ইলমদের অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে কতই না ভালো হতো। তাঁরা আগত ছাত্রদের সাথে সালাম-মুসাফাহার পর তাদের বিশ্রামের জায়গা নির্ধারণ করে দিবেন। কোথা হতে ফরম সংগ্রহ করবে, কোথায় অযু ইস্তিঞ্জা করতে হবে, কোথায় কি করতে হবে, সংক্ষেপে তা জানিয়ে দিবেন। সাথে দিকনির্দেশনা সম্বলিত বিজ্ঞপ্তিও টানানো যেতে পারে।
৬) দূরাগত ও নবাগত ছাত্রদের থাকার সমস্যা সবচেয়ে জটিল সমস্যা। দেখা যায়, ভর্তি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের কয়েকদিন থাকতে হয়। কোনো নিকটাত্মীয় না থাকায় মাদরাসাগুলোই তাদের ভরসা। এজন্য রাতে বেলা তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরী। নতুবা তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। যদি ঢাকায় এদের জন্য পৃথক সরাই বা মেহমানখানা স্থাপন করা হয়, অথবা মাদরাসাগুলোতে থাকার সুবন্দোবস্ত করা হয়, তা হলে অনেক ভালো হবে। বেশিরভাগ মাদরাসায় এ ব্যবস্থা থাকলেও নবাগত ছাত্রদের গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে।
হেফাযতের আন্দোলনের সময়কার ঢাকাবাসীর মেহমানদারীর কথা, নোয়াখালী বিজ্ঞানপ্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুক হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের থাকাখাওয়া অশাতর ব্যবস্থার কথা সুবিদিত। একটুু উদ্যোগ, আগ্রহ ও সদিচ্ছা হলে সব কিছুই সম্ভব।
৭) ভর্তির আগে অতিরিক্তি সারচার্জ নেওয়া অযৌক্তিক। কোনো কোনো মাদরাসার কথা শোনা গেছে, তারা শুধু ভর্তি পরীক্ষার জন্যই তিন থেকে পাঁচশ’ টাকা করে নিয়েছে। কয়েকশ’ ভর্তিপরীক্ষার্থীর মধ্য হতে মাত্র ১৫/২০জন ছাত্র ভর্তির সুযোগ লাভ করেছে। বাকীরা অন্যান্য মাদরাসায় চলে যেতে হয়েছে। এসব ছাত্র ভর্তির সুযোগ না-পেয়েও কয়েকশ টাকা খরচ হয়ে গেছে। একজন মুসাফির গরীব ছাত্রের জন্য এ টাকার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষকরে কয়েক মাদরাসায় যে ছাত্র ভর্তিপরক্ষীয় অবতীর্ণ হতে হবে, অতঃপর বছরের শুরুর নানা অনুষাঙ্গিক খরচের ভার বহন করতে হবে, এদের জন্য বিষয়টি অনেক ভারি। এজন্য ভর্তি ফরম ফি নামমাত্র মূল্য হওয়া বাঞ্চনীয় এবং বিষয়টি পুরোপুরি সেবামূলক হওয়া কাম্য। হাঁ, ভর্তির সুযোগ লাভ করার পর যেকোনো অর্থই যুক্তিসঙ্গত, যা মেনে নিতে কষ্ট হয় না।
৮) কোনো কোনো মাদরাসায় ভর্তি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা অনেক বেশি। যেমন, ফরম এক জায়গা থেকে, সেখান থেকে যেতে বলা হয় নাযিম সাহেবে কাছে, তারপর আবার মুহতামিম সাহেবের কাছে, তারপর আবার ভর্তির পরীক্ষকের মুখোমুখি। দেখা হয়, একজন ইলমী ইস্তিদাদ যাচাই করছেন, আরেকজন তার চুলদাড়ি জামাকাপড় নিরীক্ষণ করছেন। আরেকজন ফরম দিচ্ছেন। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ছেলেরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
৯) ভর্তিপ্রক্রিয়ার সাথে যেসব দায়িত্বশীল উস্তায রয়েছেন, দেখা যায়, তাদের অনেকেই মাদরাসায় উপস্থিত থাকেন না। ভর্তির সাথে সংশ্লিষ্ট উসতাযগণ মাদরাসায় থাকা বাধ্যতামূলক করা বাঞ্চনীয়। অথবা অনুপস্থিত উসতাযকে ভর্তির সাথে সম্পৃক্ত না করাই উচিত। এতে ভর্তিচ্ছুক ছাত্রদের কষ্ট কম হবে।
১০) ভর্তিপরীক্ষায় দীর্ঘ সময়ক্ষ্যাপন করাও ছাত্রদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। যেমন, একদিন ফরম সংগ্রহ করা, আরেকদিন, লিখিত পরীক্ষা, আরেকদিন মৌখিক পরীক্ষা, তারপর ফলাফল ঘোষণা ইত্যাদি মিলিয়ে কোনো কোনো মাদরাসা ছাত্রদের অনেক সময় নিয়ে যায়। তারপর যখন সে জানতে পারে, তার এখানে ভর্তি হচ্ছে না, তখন সে অন্য মাদরাসায় ভর্তির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। এটা দুঃখজনক। এক্ষেত্রে ন্যূনতম সময়ে ভেতর ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করাই মুনাসিব। উচ্চতর তাখাসসুস হয়ে থাকলে সর্বোচ্চ ফরমবিতরণ-লিখিত-মৌখিক-ফলাফল ঘোষণা মিলিয়ে সর্বোচ্চ দুদিন রাখা যেতে পারে। যেন কোনো কারণে ভর্তি হতে না পারলে তার বিকল্প হাতছাড়া না হয়ে যায়।
১১) অনেক মাদরাসার আশ-পাশে মানসম্মত খাবার হোটেল থাকে না। কাছে কোনো স্টেশনারী দোকান পাওয়া যায় না, যেখান থেকে কাগজ কলম ইত্যাদি সংগ্রহ করা যেতে পারে। থাকলেও নবাগত ছাত্ররা তা জানেন না। এজন্য ভর্তিচ্ছুক ছাত্রদের জন্য মাদরাসার ভেতর থাকা খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।
এসবের ভেতরও কোনো কোনো মাদরাসার ভর্তিব্যবস্থাপনা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ছাত্ররাই এঁদের প্রশংসা করেছে। এক্ষেত্রে তারা আমাদের অনুসরনীয় হতে পারে। এমন একটি মাদরাসার ভর্তি প্রক্রিয়ার বিষয়টি পরবর্তী পোষ্টে দেব ইনশাআল্লাহ।
মুহাম্মাদ সাইফুদ্দীন গাজী
দারুল হিকমাহ, চৌমুহনী, নোয়াখালী