এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ

শাইখুল হাদিস আল্লামা মাহবুবুল হক কাসেমী ছিলেন উম্মাহর দরদি খাদেম—একনিষ্ঠ আলেমেদ্বীন। আল্লাহর বিশেষ বান্দাহ। বিভিন্ন পন্থায় উম্মতের খেদমত করেছেন তিনি—কখনও দিশেহারাকে পথ দেখিয়েছেন, কখনও হাদিসের মসনদে রাসুলের বাণী শিখিয়েছেন, আবার কখনও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে; ফলে পথহারা মানুষ পথ পেয়েছে, জনে জনে শিক্ষার্থীরা কুরআন ও হাদিস পড়তে শিখেছে। ফলে সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে দ্বীনের বিশুদ্ধ পয়গাম। শাইখুল হাদিস সাহেব সম্পর্কে জাতীয় মসজিদ ‘বায়তুল মোকাররম’র সম্মানিত খতিব সাহেব মাওলানা আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে হাদিসের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকারী দুজনের নাম বলতে বললে, একজন ফরিদাবাদ জামিয়ার মাওলানা যিকরুল্লাহ খান সাহেব আর অপরজন জামিয়া লালমাটিয়ার মাওলানা মাহবুবুল হক্ব কাসেমীর কথাই আমি বলব।

 

নাম ও জন্ম পরিচয় : 

তাঁর নাম মুহাম্মদ মাহবুবুল হক। উপনাম শাইখুল হাদিস সাহেব। কাসেমী সাহেব বলেও তাঁকে চিনে মানুষ। উপাধি কাসেমী। কওমী মাদরাসার শিখর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়ন করায় তাঁকে ‘কাসেমী’ বলা হয়। পিতা ছিলেন মাওলানা শামসুল হক। তিনিও সুপ্রতিষ্ঠিত আলেম। দাদা হলেন মৌলভি নাজেম আলী হাওলাদার। মাতৃকুল ও পিতৃপুরুষ উভয়দিক বিবেচনায় তিনি একটি দ্বীনি সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে পিরোজপুর জেলায় জিয়ানগর উপজেলার রনলবুনিয়া গ্রামে ১৯৬৪ ইং সনে জন্ম গ্রহণ করেন।

 

শিক্ষাজীবন : 

শাইখুল হাদিস সাহেবের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেঘড়ি ঘরের মহাজন বাবার হাতে। অতঃপর নিজ এলাকায় প্রাইমারী শিক্ষা সমাপন করে পার্শ্ববর্তী এলাকা দারুল উলুম বাদুরা মাদরাসায় ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ ইং সাল পর্যন্ত উর্দু, ফার্সী ও মিযান জামাতে অধ্যায়ন করেন। এরপর গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া থানাধীন কাজুলিয়া মাদরাসায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৭ইং সাল পর্যন্ত নাহবেমীর ও হেদায়াতুন্নাহু জামাত পড়েন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ইং সালে গরহরডাঙ্গা দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম মাদরাসায় কাফিয়া জামাতে ভর্তি হন—এই বছর তিনি বোর্ড পরীক্ষায় প্রশংসনীয় মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হন। পর্যায়ক্রমে দেশে সর্বশেষ ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ইং সাল পর্যন্ত আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় শরহেজামী, শরহে বেকায় ও হেদায়া জামাত সমাপ্ত করেন। এইবার দেশের গন্ডি পেরিয়ে তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ইং সাল পর্যন্ত দারুল উলুম দেওবন্দ ভারতে জালালাঈন, মেশকাত, তাকমিলে দাওরা ও তাকমিলে আদব বিভাগে লেখা-পড়া করেন—এরমধ্যে মেশকাত জামাতে মেধাতালিকায় সিরিয়াল নম্বরসহ প্রসংশনীয় নম্বরে উত্তীর্ণ হয়ে স্বনামের সাথে দারুল উলুম উলুম দেওবন্দে পড়া-লেখা সমাপ্ত করেন।

 

কওমিধারা শেষ হতেই শুরু হয় পড়ালেখার অন্য একটি অধ্যায়। ১৯৮৭ইং সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ভারত এর অধিনে মাস্টার্স সমমানের উর্দু সাহিত্যের উপর “কামেল” পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। সেখানেও প্রশংসনীয় ফলাফল অর্জন করেন।

 

কর্মজীবন : 

শিক্ষকতার পেশায় আসার পূর্বের ঘটনা। কীভাবে এলেন এই মহান পেশায় ; তখন তাকমিলে দাওরায় দারুল উলুম দেওবন্দে পূর্ণ নম্বর ৫০ এর মধ্যে গড় নম্বর ৪৮ থেকেও বেশী হওয়ায় নিয়ম অনুসারে ইফতাতে ভর্তির তালিকায় নাম এসে যায় শাইখুল হাদিস সাহেবের, কিন্তু দারুল উলুমের সদরুল মুদাররিসীন উস্তায হযরত মাওলানা মেরাজুল ইসলাম সাহেবের পরামর্শ ও নির্দেশনায় ইফতা থেকে নাম কাটিয়ে তাকমিলে আদবে ভর্তি হন। কথা ছিল, পরবর্তী বছর হযরত মাওলানা মেরাজ সাহেব দারুল উলুম করাচিতে ইফতা পড়তে পাঠাবেন—মুফতি তাকী উসমানীর কাছে। উস্তাযের কথামতো সব প্রস্তুতি চলছিল, কিন্তু ঠিক রওয়ানার একদিন পূর্বে দারুল উলুম দেওবন্দের শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা নাসির খান সাহেবের গুরুতর নির্দেশে ‘জামিয়া লতিফিয়া রাজেস্থান মাদরাসায়’ বুখারী শরীফ ও তিরমিজী শরীফের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এখান থেকেই তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সূচনা। এখানেই ছিলেন তিনি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ইং পর্যন্ত। প্রথম বছর থেকেই বুখারী ২য় খণ্ড, তিরমিজী ১ম খণ্ড, মুসলিম ১ম খণ্ড ও মিশকাত ১ম খণ্ড পড়ান। দ্বিতীয়ত ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ইং জামিয়া রহমাতুল্লাহ আমলাপাড়া মাদরাসায় শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হন। এসময় বুখারী শরীফ ২য় খণ্ড, মিশকাত শরীফ ১ম খণ্ড, হেদায়া ৩য় খণ্ড, মুছাল্লামুছ ছবুত, সুল্লামুল উলুম ও কাফিয়ার মতো বড়সড় কিতাবাদী পড়াতেন। এরপর ১৯৯৯ থেকে ২০০০ইং পর্যন্ত জামিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসায়—বায়যাবী শরীফ, হেদায়া ২য় খণ্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদী অধ্যাপনার দায়িত্বে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০০ইং সালে জামিয়া আশরাফুল উলুম বড় কাটারা মাদরাসায় বুখারী শরীফের ২য় খণ্ড ও পাশাপাশি জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদরাসায় শাইখুল হাদিস হিসেবে যুক্ত হন। বলাবাহুল্য, তিনি এখানে দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) জামাত খোলার বছর ২০০১ সাল থেকে বুখারী শরীফের ১ম খণ্ড ও তিরমিজী শরীফের ১ম খণ্ড পড়ান—এমনকি মৃত্যুর আগ মূহুর্ত ২০২৫ পর্যন্ত তিনি এই লালমাটিয়া মাদ্রাসার খেদমতকে প্রাধান্য দিয়ে পাশাপাশি আরও “জামিয়া ইসলামিয়া রবিউল উলুম” ও জামিয়া শারিফিয়া আরাবিয়া এবং নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান “জামিয়াতুল আবরার কামরাঙ্গীরচ’ মাদ্রাসায় বুখারী শরীফ পড়িয়েছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, এই মহান মনীষী দীর্ঘ ৩৯ বছর হাদিসের সর্বোচ্চ গ্রন্থ ‘বুখারি’র খেদমত করেছেন। বিশেষত শাইখুল হাদিস সাহেবের হাতে প্রতিষ্ঠিত ‘জামি’আতুল আবরার’ কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসার কথা না বললেই নয় ; জামিয়াতুল আবরার’র জন্য কি না তিনি করেছেন, ইবতেদায়ি জামাত থেকে শুরু করে দাওরায়ে হাদিস ও তাখাচ্ছুস পর্যন্ত তিলে তিলে গড়ে গিয়েছেন। এই জামিয়াতেই তিনি জীবনের শেষ সময়গুলোর অধিক ব্যয় করেছেন। শুধু কি মাদ্রাসার খেদমত—না, হাদিসের খেদমতের পাশাপাশি ১৯৯১ইং থেকে ২০১৯ইং পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ ‘কেল্লা শাহী মসজিদে’ স্বনামের সঙ্গে খেতাবতের দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

পারিবারিক জীবন :

চিরাচরিত সত্য কথা—মাওলানা সাহেব মাদরাসা ও খেদমতের পাশাপাশি পরিবারকেই সমানভাবে সময় দিতেন। এতে পরিবারের ছিল না কোনো অভিযোগ। মাওলানা নিয়ম করে প্রতিদিন দ্বীনের কাজে মগ্ন থাকেন—তাঁর ব্যাপারে অভিযোগ থাকবেই বা কেন! সহধর্মিনী তো ছিলেন গুণবতী নারী। একজন মহীয়সী রমণী। মাওলানার প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মাওলানা সাহেবও ছিলেন তাঁর প্রতি অনুরাগী। সুখময় জীবন তাঁদের। ভালোবাসা টইটুম্বর দুজনের সংসারজুড়ে। খুনসুটি ও অভিমান থাকবে এগুলো সম্পর্কের সৌন্দর্য। স্ত্রী মাওলানার ঘরনি হয়ে যে সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন, সবসময় তার কৃতজ্ঞতা মুখে ও কাজে ছিল—এক্ষেত্রে মাওলানাও ভিন্ন নন! দুজনের সংসারে তিন সন্তান এসেছে ফুল হয়ে। এক মেয়ে দুই ছেলে। মেয়ে সবার বড়, বিবাহিত ; দুই সন্তানের জননী। মেয়ের জামাই মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব প্রতিষ্ঠিত ‘মারকাজুদ দাওয়াহ’র মুদাররিস হযরত মাওলানা মুফতি হুসাইন আহমাদ। বড় ছেলে জামিয়া শারিফিয়া আরাবিয়া এর সম্মানিত মুদাররিস। আর ছোট মাওলানা মারগুবুল হক। তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য এখনও অধ্যানরত আছেন। তাঁরা পিতার অপূর্ণ জায়গাটা পূর্ণ করবে বলে আশাবাদী।

 

ইসলাহি জীবন : 

দারুল উলুম দেওবন্দে মেশকাত জামাত পড়াকালীন (১৯৮৩ইং) মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা মছিহুল্লাহ খান সাহেব জালালাবাদী রহ. এর হাতে বায়আতে সুলুক গ্রহণ করেন। হযরত মাওলানা মছিহুল্লাহ খান সাহেবের ইন্তেকালের পর হযরত থানবী রহ. এর খলিফা হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক সাহেবের হাতে রুজু ও বাইআত গ্রহণ করেন। হযরত রহ. এর ইন্তেকালের পর হযরত আল্লামা মাওলানা কমরুদ্দীন সাহেব (শাইখে সানী দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত) এর হাতে রুজু ও বাইআত গ্রহণ করেন এবং ইজাযত ও খেলাফতপ্রাপ্ত হন।

 

দাওয়াতি সফর : 

শাইখুল হাদিস সাহেব বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এমনকি দেশের বাইরেও মধ্যপ্রাচ্যের সৌদী আরব, থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানসহ অসংখ্য শহর নগরে দাওয়াতি সফর করেছেন।

 

মৃত্যু : 

মানুষ জন্মগ্রহণ করে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণের জন্য নির্ধারিত হয়েই। চলে যাবার এই সিলসিলায় শাইখুল হাদিস সাহেবও জন্মেছেন মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়েই। সময়ের কাঁটা ঘুরে তাই তাঁর হায়াতের সময় শেষ হয়েছে ১৪৪৭ হিজরির ২৩ জুমাদাল আখিরাহ মোতাবেক ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ইং । রোজ সোমবার সকাল ৮.২০ মিনিটে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসারত অবস্থায় পৌঁছে যায় আরশে আজিমে। ইন্তেকালের সময় তার বয়স ৬১ বছর। আল্লাহ তাঁকে সহস্র ফুলের বর্ণিলায় জান্নাতের ঘ্রানে বিমোহিত করুন। আমিন।

Jubokantho24 Ad
এ জাতীয় আরো সংবাদ
এ জাতীয় আরো সংবাদ