
মুনশি নাঈম:
আন্দোলন-সংগ্রামে সবসময় তৎপর ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, তারপরে যত ইসলামি আন্দোলন হয়েছে, সবগুলোতেই সরব সমর্থন ছিলো এ জেলার অধীবাসীদের। এ পর্বে থাকছে এমনই কিছু আন্দোলনের গল্প।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এ জেলায় বিস্ফারিত না হলেও পুরো ভারতবর্ষে যারা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমনকি যারা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের অনেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। এদের মধ্যে অন্যতম বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত। তার জন্ম হয় তদানিন্তন অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামে। তার পিতার নাম দ্বিজদাস । তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এর ছাত্র ছিলেন, এবং পরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে কলেজে পড়ার সময় ইংরেজ অধ্যাপক রাসেল বাঙালিদের সম্পর্কে কটূক্তি করার দরুন উল্লাসকর তাকে আঘাত করেন, এজন্য উল্লাসকরকে কলেজ হতে বহিষ্কার করা হয়েছিল । এই সময় থেকে তার জীবনে পরিবর্তন আসে।
উল্লাসকর যুগান্তর দলে যোগ দেন। তিনি বিস্ফোরক নির্মাণে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তার ফর্মুলায় তৈরী বোমা পরীক্ষা করার জন্যে একদল বিপ্লবী বেছে নেন দেওঘরের নিকট নির্জন দীঘারিয়া পাহাড়। ১ মে, ১৯০৮ সালে সেই পরীক্ষার দিন বোমা ছোড়ার সময় আহত হয়ে মারা যান বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তী ও উল্লাসকর মারাত্মক জখম হন। গোপনে কলকাতায় তার চিকিৎসা করেন ডাক্তার ও বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক। উল্লাসকরের তৈরি বোমাই ক্ষুদিরাম বসু ও হেমচন্দ্র দাস ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে আক্রমণে ব্যবহার করেছিলেন। তবে এই হামলা বানচাল হয়ে যায়, এবং পুলিশ উল্লাসকর দত্ত সহ যুগান্তর দলের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করে। এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় অভিযুক্ত হয়ে তিনি বীরেন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গে দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি লাভ করেছিলেন । ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ মে তিনি পরলোক গমন করেন ।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনবার কারাভোগকারী , একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী আরেক সন্তানের নাম শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। তৎকালীন বাংলা প্রদেশের ত্রিপুরা জেলার (বর্তমানের বাংলাদেশ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন কসবা ও নবীনগর মুন্সেফ আদালতের সেরেস্তাদার। ধীরেন্দ্রনাথ পড়াশোনা করেছেন নবীনগর হাই স্কুল, কুমিল্লা কলেজ, এবং কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং ব্যারিস্টার আবদুর রসুলের রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে তিনি তিন মাসের জন্য আইন ব্যবসা স্থগিত রাখেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন, বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনি আইন পাসের সাথে ধীরেন দত্ত সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দেন। ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়ে বিভিন্ন কারাগারে বিনাশ্রম ও সশ্রম দণ্ড ভোগ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৭ মার্চ রাতে তাঁকে কুমিল্লার বাসভবন থেকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যান এবং পরেরদিন তিনি পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন ।
ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী বিপ্লবী শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী। তাদের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। তারা দুজন কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. স্টিভেন্সকে ১৯৩১ সালে ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করেন । বিচারে শান্তি ও সুনীতি চৌধুরীর দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। তারা হাসিমুখেই কারাবরণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছিল । এর প্রধান কারণ জেলার ভৌগলিক অবস্থান । এখান থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সাথে রয়েছে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, সীমান্ত এলাকা এবং সীমান্তের ওপার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপর দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে । মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসই জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত হয়েছে সম্মুখ যুদ্ধ । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫ সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে মুক্তিযুদ্ধে। এছাড়া বিচ্ছিন্ন কিছু দালাল-রাজাকার ব্যতীত তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমার প্রায় ১০ লাখ মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন । মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ অঞ্চল ২ নং সেক্টরে এবং কিয়দাংশ ৩ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। তিনি তাঁর সেক্টরকে ৬টি সাব-সেক্টরে ভাগ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয় এবং এদিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণ সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করেন। ২৭ মার্চ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়োজিত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম তার সাথের বাঙালি সেনাদের নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর্মি ক্যাম্পের সকল পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যকে বন্দি করেন। ঐদিন দুপুরে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম মৌলভীবাজারের শমসেরনগর হতে তার সেনাদল নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসেন এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল তার কাছে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানির দায়িত্ব অর্পণ করেন।
২ নং সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্রগুলো হল আকছিনা, আখাউড়া, আসাদনগর, আড়াইবাড়ী, ইব্রাহীমপুর, কালীকচ্ছা, কুল্লাপাথর, চন্দ্রপুর, চারগাছ, চেকপোস্ট সড়ক, ঝগড়ার চর, তারাগণ, তুল্লাপাড়া, দেবগ্রাম, দরুইন, দুর্গারামপুর, দশদোনা, নবীনগর সদর, ফুলবাড়ীয়া, বায়েক, মিরপুর, লতোয়ামুড়া, শাহবাজপুর, হরিয়াবহ এবং ক্ষীরণাল।
২৮ মার্চ মেজর খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হানাদার মুক্ত হয়, কিন্তু ১৬ এপ্রিল পাকবাহিনী বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে পুনরায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়া দখল করে নেয়। ১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন, শাহজাহান, ল্যান্স নায়েক আ. হাই, সুবেদার সিরাজুল ইসলাম এবং সিপাহী আব্দুর রহমান শহীদ হন। ১৮ এপ্রিল আখাউড়া উপজেলার দরুইনে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মুখোমুখি লড়াইয়ে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল শহীদ হন। এ গ্রামেই বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামালকে সমাহিত করা হয়।
৫ মে সরাইল উপজেলায় লেফটেন্যান্ট হেলাল মুর্শেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা শাহবাজপুরে পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করলে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ২২ নভেম্বর কসবা উপজেলার লতোয়ামুড়া ও চন্দ্রপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কুল্লাপাথরে অপর এক লড়াইয়ে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কসবা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে গড়ে তোলা হয়েছে কুল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ। এখানে ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে।
৯ ডিসেম্বর সকালে পাকবাহিনী আশুগঞ্জ-ভৈরব রেলসেতুর আশুগঞ্জের একাংশ ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে। সেতু ধ্বংস করার পর পাকবাহিনী আশুগঞ্জ ছেড়ে চলে গেছে এমন ধারণা থেকেই যৌথবাহিনী আশুগঞ্জ দখল করতে অগ্রসর হয়। আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রায় ৫০ গজের মধ্যে আসামাত্র পাকবাহিনী অগ্রসরমান ১৮ রাজপুত বাহিনীর উপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। হামলায় মিত্রবাহিনীর ৪ জন সেনা অফিসারসহ ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। নাসিরনগর উপজেলার ফুলবাড়ীয়া গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধা ছিদ্দিকুর রহমান শহীদ হন এবং তুল্লাপাড়া গ্রামের বটতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে একজন রাজাকারসহ ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছা বাজারের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা দলের মাইন বিস্ফোরণে দুটি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে পাকবাহিনীর কয়েকজন অফিসার ও সরাইলের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিহত হয়।
৫ আগস্ট বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় পাকবাহিনী উজানচর ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামে গণহত্যা চালায়। ১৫ নভেম্বর নাসিরনগর উপজেলার নাসিরনগর সদর, কুন্ডা, বোলাকোট ও গোকর্ণ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে পাকবাহিনীর হামলায় বহুসংখ্যক নিরীহ মানুষ নিহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপজেলার কাউতলী, পৈরতলা, সিঙ্গারবিল, নাটাই, মজলিশপুর, বিজেশ্বর, রামরাইল ও আটলায় পাকবাহিনী প্রায় ২০৪ জন নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়াও পাকবাহিনী বুধন্তী ইউনিয়নের বীরপাশা গ্রামে ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সরাইল উপজেলার বিটঘর এলাকায় পাকবাহিনী ৭০ জন লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। আশুগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকবাহিনী সন্দেহভাজন লোকজনদের ধরে এনে সাইলো বধ্যভূমিতে নির্যাতন করে হত্যা করে। বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫ জন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে এখনো। এরমধ্যে গণকবর ৬ (খারঘর, নবীনগর পাইলট হাইস্কুল মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে, নবীনগর থানা কম্পাউন্ডের দক্ষিণাংশে, মগরা গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়, আখাউড়া ত্রিপুরা সীমানাস্থ সেনারবাদী, লালপুর বাজার), বধ্যভূমি ১ (আশুগঞ্জ সাইলো), স্মৃতিস্তম্ভ ৩, ভাস্কর্য ১, শহীদ সমাধি ৮ (লক্ষ্মীপুর, কোল্লাপাথর, শিমরাইল ও জমশেরপুর)। এছাড়া আখাউড়া উপজেলার দরুইন গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামালের সমাধি অবস্থিত।
ফতোয়া আন্দোলন
২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাবাজার পত্রিকায় নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিথা গ্রামে এক গৃহবধূকে ফতোয়া দিয়ে হিল্লা বিয়ে করতে বাধ্য করার বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার আদালত কেন ফতোয়া প্রদানকারী হাজি আজিজুল হকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না—এ বিষয়ে নওগাঁর জেলা প্রশাসক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি এক স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমেটো) রুল জারি করেন। পরে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি দুই বিচারপতি ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে বলেন, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইনসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
ইসলাম ও শরিয়াহর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক এ রায়ে চমকে ওঠেন এ দেশের ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী এবং উলামায়ে কেরাম। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। ঠিক সে সময় আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. হাইকোর্টের রায়দাতা দুই বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও নাজমুন আরা সুলতানাকে মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে ফতোয়া প্রকাশ করেন। এবং হাইকোর্টের ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায়ের বিরুদ্ধে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেন। পুরো দেশ তখন আমিনী রহ.-এর এই সাহসী আহ্বানে সাড়া দিয়ে গর্জে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে হকপন্থী সমস্ত উলামায়ে কেরাম তাঁকে সমর্থন জানান।
৪ ফেব্রুয়ারি দিনের বেলা মুফতি আমিনী রহ.-কে লালবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপর এই দিনই রাতের বেলা দিনাজপুরের একটি জনসভা থেকে ফেরার পথে গাজিপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, আবদুল লতিফ নিজামি, মুফতি ইজহার , জুনায়েদ আল হাবীবসহ আরও অনেক নের্তৃবৃন্দকে।
সরকার ভেবেছিল আন্দোলনের এই নের্তৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু ফল দাঁড়াল ঠিক এর বিপরীত। জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিলে যেমন হয়, পুরো বাংলাদেশ সেভাবে গর্জে উঠল তাঁদের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে। ৩-৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। চলতে থাকে সরকারের দমন-পীড়নও।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় হুজুর ও জামিয়া ইউনুছিয়ার তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা সিরাজুল ইসলাম রহ. ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারির হরতালের পর ঘোষণা দেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক এবং মুফতী আমিনীকে মুক্তি না দিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাগাতার আন্দোলন চলবে। ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি হরতালের ঘোষণা দেন। ৫ ফেব্রুয়ারিও মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর।
৬ ফেব্রুয়ারি ভোর হবার আগে আগেই পুরো শহরে বিডিআর ও পুলিশের বিশেষ ফোর্স মোতায়েন করা হয়। জামিয়া ইউনুছিয়া থেকে ফজর নামাজের আগে আগেই অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। ফজরের পর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবকয়টি মাদরাসার ছাত্র-উসতাদ এবং শহরের ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতা হরতাল কর্মসূচি পালনের জন্য রাস্তায় নেমে আসেন।
ফজরের পর জামিয়া ইউনুছিয়া থেকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সহকারে শহরের প্রাণকেন্দ্র টিএ রোড হয়ে কালিবাড়ির দিকে মিছিল চলে। কালিবাড়ি পৌঁছুতেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাধা দেয়। মিছিল পুনরায় ফিরে আসে টিএ রোডে। এখানেই অবস্থান করে হরতাল কর্মসূচি পালন করতে থাকে সবাই।
ধীরে ধীরে বেলা বাড়তে থাকে। পুলিশ এবং বিডিআর সদস্যরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আন্দোলনকারীদের ঘিরে রাখে, নানাভাবে বাধা দিতে থাকে। ফলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও বিডিআর যাকে পারছে, গ্রেপ্তার করছে।
সেসময়কার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর মাদরাসার বর্তমান শিক্ষক মাওলানা বোরহানুদ্দীন ফাতেহ টুয়েন্টিফোরকে জানান, বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এবং বিডিআর সদস্যরা আন্দোলনরত জনতার অবস্থানকে ক্রমশ সংকুচিত করে আনছিল। বেলা ১০টার দিকে তারা একটা লাল ব্যানার টাঙিয়ে ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা এই ব্যানার অতিক্রম করে যেতে পারবে না। উত্তেজিত জনতা তখন ব্যানার অতিক্রম করে আর তখনই শুরু হয় পুলিশ ও বিডিআরের নির্বিচার গুলি বর্ষণ।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এবং ৬ ফেব্রুয়ারির ৬ শহিদের শাহাদতের প্রত্যক্ষদর্শী মুফতী এনামুল হাসান ফাতেহ টুয়েন্টিফোরকে বলেন, সারা শহরেই তারা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি বর্ষণ ও নির্যাতন শুরু করে। আন্দোলনে মাদরাসাছাত্র ছাড়াও সর্বস্তরের তৌহিদি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। অসংখ্য মানুষ আহত হচ্ছিলেন। দুপুর পর্যন্ত এই তাণ্ডব চালিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় প্রশাসন। ততক্ষণে ছয়টি তাজাপ্রাণ ঝরে পড়েছে। প্রশাসনের নৃশংসতার শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন জামিয়া ইউনুছিয়ার ছাত্র হাফেজ তাজুল ইসলাম ও হাফেজ সাইফুল ইসলাম। সাধারণ তৌহিদি জনতার মধ্য থেকে প্রাণ দিয়েছেন শহিত মুখলিসুর রহমান, শহিদ সুজন, শহিদ আলাউদ্দিন ও শহিদ উসমান। এ চারজনই ছিলেন সাধারণ মানুষ। ধর্মীয় অনুভূতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা এ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।’
মাওলানা বোরহানুদ্দিন জানান, প্রশাসনের এ নৃশংসতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল।
ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতী মাওলানা তৈয়ব ফাতেহ টুয়েন্টিফোরকে বলেন, ৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে পুলিশ ও বিডিআর সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আন্দোলনরত আপামর জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। এতে অসংখ্য মানুষ গুরুতর আহত হবার পাশাপাশি ৬ জন সাধারণ মুসল্লি ও মাদরাসা ছাত্র শাহাদত বরণ করেন। আন্দোলন আরও বেগবান হয়৷ সরকার বাধ্য হয় মুফতী আমিনী ও শায়খুল হাদীস রহ.-কে মুক্ত করে দিতে। এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। নির্বাচন আসে। এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করে। চারদলীয় ঐক্যজোট আসে ক্ষমতায়।
শহীদদের স্মরণে ও নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুর ২ টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর মুক্তমঞ্চে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল জনসভা। ভয়, আতঙ্ক, প্রশাসনের হয়রানি এবং শ্যেন দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে জনতার উত্তাল তরঙ্গ থেকে ভেসে আসে আল্লাহু আকবার ধ্বনি। পৌর মুক্তমঞ্চ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উপচে পড়া জনতা অবস্থান নেয় রাস্তায়। জনসভায় উপস্থিত হন পীর সাহেব চরমোনাই রহ.। ঐ জনসভায় প্রত্যেক শহিদের পরিবারকে নগদ ১০ হাজার টাকা করে দেন। পরে বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আমীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করিম, পীর সাহেব চরমোনাই রহ. ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শহীদবাড়িয়া হিসেবে নামকরণের ষোষণা দেন। এরপর থেকে ৬ শহীদের ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শহীদবাড়িয়া করার জোর দাবি ওঠে দল মত নির্বিশেষে সর্ব মহলে। সেসময় অনেক দোকান-পাট, হোটেল-রেস্তোরা সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থলে শহীদবাড়িয়া লেখা শুরু হয়ে যায়।
মুফতি আমিনী রহ. এর নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও শিক্ষা নীতি বিরোধী আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণ ছিলো তক্কে তক্কে। পরবর্তীতে হেফাজতের আন্দোলনেও তারা শরীক ছিল। ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন ইস্যুর প্রতিবাদে এ জেলার গনগণকে সরগরম থাকেত দেখা যায় সবসময়। এসব আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকে জামিয়া ইউনুছিয়াসহ জেলার বড় কয়েকটি কওমি মাদরাসা। সব আন্দোলনেই কওমি ছাত্র জনতার বিরাট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।