ই মা রা তে ই স লা মি য়া সফরের অভিজ্ঞতা : মাওলানা মামুনুল হক

আমাদের ই মা রা তে ই স লা মি য়া আ ফ গা নি স্তা ন সফরটা মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টিকারী একটা সফর ছিল। এক দিক থেকে এটা একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়ও ছিল। তবে বরাবরই আলহামদুলিল্লাহ চ্যালেঞ্জ নিতে আমি বেশি একটা ভয় পাই না। আল্লাহ পাকের মেহেরবানি, আফগান সফরের ক্ষেত্রেও আমার মধ্যে কোনো দ্বিধা এবং জড়তা কাজ করেনি।

আ ফ গা নি স্তা ন সফরের অভিজ্ঞতা খুব সংক্ষিপ্তভাবে বলাটা আসলে খুব কঠিন। কারণ সেখানে আমরা যা কিছু দেখেছি, যা কিছু বুঝেছি, অনুভব করেছি, তাতে একটা সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাই আমাদের হয়েছে।

আ ফ গা নি স্তা নের মৌলিক যে অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম হলো-
সেখানে ইসলামি শ রি য়া হ তথা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আধুনিক যুগে একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা পরিচালনা করছে। ইসলামের বিধান পালনের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোনো মানসিকতার তাদের মধ্যে নেই। তারা পরিপূর্ণই শরিয়াহ মোতাবেক যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টা নজর কাড়ে, সেটা হলো- ৩০ জনের মত মন্ত্রী পরিষদ। তার ২-৩ জন বাদে সবাই মাদরাসাপড়ুয়া আলেম। কওমি মাদরাসা তথা দেওবন্দি সিলসিলায় তারা পড়াশোনা করেছেন। কেউ পাকিস্তান থেকে। কেউ আ ফ গা নি স্তান থেকেই। আর দুই একজন আছেন যারা হয়ত বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় পড়াশোনা করেছেন। সম্পূর্ণ একটা সরকারব্যবস্থাই পরিচালিত হচ্ছে কওমি মাদরাসার আলেমদের মাধ্যমে। এটা হলো একটা দেখার বিষয়।

তৃতীয় যে বিষয়টা আমাদের জন্য লক্ষণীয় ছিল, সেটা হলো-
সেই রাষ্ট্রের নিয়মনীতি, বিধিমালা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পাদিত যাবতীয় চুক্তি এমনকি ‘দোহা চুক্তি’ যেটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ; এ বিষয়গুলোকে শতভাগ তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এবং কুরআন-সুন্নাহর মানদণ্ডে যাচাই করে পরিচালনা করছে।
এ জন্য সারাদেশের ৩৪ প্রদেশ থেকে বাছাইকৃত শীর্ষ আলেমদের নিয়ে মজলিসে শূরা আছে। মজলিসে শূরার অনুমোদন ছাড়া সেখানে কিছুই হয় না। আর এই মজলিসে শূরার মাথার ওপর আছেন আমিরুল মুমিনিন। আমিরুল মুমিনের অবস্থানটা সেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গোটা জাতির মধ্যে তার প্রতি যে ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা; এক কথায় বলতে গেলে অভূতপূর্ব। প্রত্যেকটা মানুষ হৃদয়ের গহীনে থেকে তাকে ভালোবাসে। তাকে শ্রদ্ধা করে এবং তার আনুগত্য করাকে নিজেদের জন্য জরুরি মনে করে। যার কারণে তাকে কেন্দ্র করে জাতির মধ্যে অভূতপূর্ব একটা ঐক্য সূচিত হয়েছে।
এগুলো তো রাষ্ট্রের মূল কাঠামোগত বিষয়।

২০২১ থেকে ২০২৫ চার বছরের বেশি সময় ধরে একটা পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা পরিচালনা করছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনায় স্বাভাবিকভাবেই আর্থিক বিষয়টা তো অনেক বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সেখানে সারা পৃথিবীর অসহযোগিতা রয়েছে। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রের সাথেই তারা প্রোপার চ্যানেলে কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন করতে পারছে না। সর্বশেষ শুধু রাশিয়া তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর বাইরে ৪২টি রাষ্ট্রের সাথে প্রাথমিক একটা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে। ৪২টি রাষ্ট্রে তাদের ডিপ্লোমেট আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কোনো ব্যাংকিং চ্যানেল নেই। যার কারণে প্রোপার উপায়ে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা সেখানে আসার সুযোগ নেই। শুধু দুইটা অভ্যন্তরীণ সোর্স থেকে তাদের রাষ্ট্রের আয় নির্বাহ হচ্ছে।
একটা হলো কিছু কাস্টমস তারা পায়। তাদের দেশের সড়কপথ ব্যবহার করে আরবের কিছু দেশ থেকে মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলোতে যে পণ্যবাহী গাড়ি যাতায়াত করে, আ ফ গানিস্তান ছাড়া তাদের বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। ওই জায়গা থেকে তারা বড় একটা শুল্ক পায়। এটা হলো একটা আয়ের উৎস।
আরেকটা বড় আয়ের উৎস হলো তাদের যে খনিজসম্পদ, এটা আল্লাহ পাকের মেহেরবানি তাদের ওপর। বিপুল পরিমাণ খনিজসম্পদের সমাহার তাদের দেশে আছে। স্বর্ণের খনি, গ্যাসের খনি, কয়লার খনি- এছাড়াও আরও অনেক খনিজসম্পদের মজুদ তাদের আছে। চীনের সহযোগিতায় এখন তারা সেই খনিগুলো উত্তোলন করছে। এই দুইটা সোর্স থেকেই মূলত তাদের জাতীয় আয়।

তারা যে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে এবং যে ব্যয় নির্বাহ করছে, সেটা লক্ষণীয়। তারা যখন ক্ষমতায় আরোহণ করে তখন এক ডলারের বিপরীতে ছিল ১৩০ আফগানি (আফগান মুদ্রা)। চার বছরে যেখানে সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক অনেক উত্থান পতন হয়েছে। কোভিডসহ নানা কারণে পৃথিবীর দেশে দেশে মুদ্রার মান কমেছে। আমাদের বাংলাদেশি মুদ্রার মানও ডলারের বিপরীতে অনেক কমেছে। সেই জায়গায় এখন আফগানি মুদ্রা এক ডলারের বিপরীতে ৬৫-৬৬। তো এটা হলো একটা দিক। বাস্তবেও আমরা যেটা দেখলাম, আগে কাবুলে যে বাড়ির মূল্য এক লক্ষ ডলার ছিল, চার বছরের ব্যবধানে সেটা দুই লক্ষ ডলারে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ তাদের অর্থনীতি অভ্যন্তরীণভাবেই ব্যাপক সমৃদ্ধ হয়েছে। তাদের আর্থিক সক্ষমতা একটা জিনিস থেকে অনুমান করা যায়। সেটা হলো, তাদের দেশে ৪০ বছর ধরে যুদ্ধ চলছে। ২৫ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে। বিশেষ করে বিগত ২০ বছর ধরে ন্যাটো এবং পশ্চিমা মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যে লড়াই এবং সংগ্রাম চলছে, এই সংগ্রামে প্রচুর শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছে। যার কারণে এতিম এবং শহীদদের বিধবা পরিবার রয়েছে বিপুল পরিমাণ। ই মা রা তে ইসলামিয়া তাদের সবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। ৩৪টি প্রদেশের প্রত্যেকটিতেই তারা সরকারিভাবে একটা করে এতিমখানা নির্মাণ করেছে। সুন্দর ইমারত, আধুনিক ব্যবস্থাপনা সুইমিংপুলসহ। তাদের লালন-পালন, শিক্ষা-দীক্ষা, ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সব সরকার বহন করছে। যথেষ্ট সমৃদ্ধ ব্যবস্থাপনা। ইন্টারেস্টিং যে ইনফরমেশন সেটা হলো, ৮ লক্ষ পরিবারকে তারা প্রতি মাসে ভাতা দেয়। সে ভাতার পরিমাণটাও পরিবারপ্রতি কমপক্ষে ৫ হাজার আফগানি। অর্থাৎ প্রায় ১০০ ডলার। সেই হিসেবে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার শুধু ভাতা দিচ্ছে।
এর চেয়েও বড় আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তাদের বিরুদ্ধে মানবিক বিবেচনায় অনেক অভিযোগ করা হয়; অথচ এই যে ৮ লক্ষ পরিবারকে তারা ভাতা দিচ্ছে, এর মধ্যে শত্রু-মিত্রের কোনো তারতম্য তারা করে না। তারা যেমনিভাবে তাদের পক্ষীয় শহীদদের পরিবারদের ভরণ-পোষণ দিচ্ছে, তেমনিভাবে তাদের বিপক্ষীয় নিহতদের পরিবারকেও ভাতা দিচ্ছে। এই তথ্য সরাসরি তাদের মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই অন্তত ৮ লক্ষ পরিবারকে তারা ভাতা দিচ্ছে। আমি মনে করি এটা অনেক বড় অর্থনৈতিক একটা সক্ষমতার বিষয়।
এর বাইরে যে কাজটা করছে সেটা হলো, তারা ব্যাপকভাবে উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করছে।
উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তানসহ চার-পাঁচটা দেশের সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত আছে ।সেই সীমান্তের মাঝখান দিয়ে একটা নদী প্রবাহিত হয়েছে, যেটা আ ফ গানিস্তানের মূল নদী। এটাকে ‘আমু নদী’ বলা হয়। ঐতিহাসিকভাবে মা-ওয়ারাউন্নহর বললে আমরা একটা নদীর কথা জানি, এটাই সেই নহর। এই নহরের অপর পাশের বুখারা, সমরকন্দ প্রভৃতি এলাকার উলামায়ে কেরামকে ফিকহে হানাফির পরিভাষায় উলামায়ে মা-ওয়ারাউন্নহর বলা হয়। আফগানিস্তানের সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত এই আমু নদী থেকে তারা ভেতরের দিকে ২৮০ কিলোমিটারব্যাপী কৃত্রিম নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে, যার ৮০-৯০% কাজ প্রায় শেষ।
এরকম বেশ বড় বড় অনেক ড্যাম নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাদের কথা হলো, বিগত ৫০ বছর ধরে এ সমস্ত প্রকল্প শুধু আলোচনায় ছিল, কিন্তু কেউ এগুলো হাতে নেওয়ার সাহস করেনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সে ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

তাদের টার্গেট হলো ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। আভ্যন্তরীণ চাহিদা হলো ১২ থেকে ১৫ হাজার এবং বাকি ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাইরে সেল করবে। আগামী চার বছরে সাড়ে ছয় লক্ষ বর্গকিলোমিটার আফগানের প্রতিটি ঘরে ঘরে তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করার পরিকল্পনা করছে ।
এসব থেকে বোঝা যায়, তাদের আত্মবিশ্বাস, কর্মপরিকল্পনার মাত্রা। উন্নয়নমূলক এই কর্মযজ্ঞ কিন্তু কোনো বিদেশি কোম্পানি না,বরং সব লোকাল কোম্পানি দ্বারাই করছে। বিদেশি চাইনিজ কোম্পানি থেকে শুধু খনি উত্তোলনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের একটা ভিত ইতিমধ্যেই তারা স্থাপন করে ফেলেছে।

৯৫% আলেম-উলামা দ্বারা যে রাষ্ট্র পরিচালিত, সেই রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহের জন্য সাচিবিক দায়িত্ব যারা পালন করছে তারাও মাদরাসাপড়ুয়াই। চারজন মন্ত্রীর সাথে আমাদের কথা হয়েছে- পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পানি ও বিদ্যুৎমন্ত্রী, সমাজকল্যাণ ও শ্রমমন্ত্রী, ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ নামে একটা মন্ত্রণালয় আছে,তার ডেপুটি মন্ত্রী। এছাড়া খোস্ত প্রদেশের গভর্নর, প্রধান বিচারপতিসহ অনেকের সাথে আমরা বৈঠক করেছি। তারা শুধু পশতু ভাষাতেই দক্ষ। মন্ত্রীরা অন্য ভাষা খুব একটা ব্যবহার করেন না। কেউ কেউ, যারা পাকিস্তানে পড়াশোনা করেছেন, তারা উর্দু ও আরবি বোঝেন। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের দপ্তরে দোভাষী আছে, খুব ফ্লুয়েন্টলি এবং স্মার্টলি তারা ইংলিশ বলছে এবং তারা সবাই আলেম। কেউ মুফতি, কেউ মাওলানা সাহেব। তারা সবাই এই দুই চার বছরের মধ্যে খুব ভালোমানের ইংলিশ আয়ত্ত করে দোভাষীর কাজগুলো করছে। খুব বিশ্বস্ত লোক ছাড়া সেখানে কেউ কাজ করছে বলে মনে হলো না এবং অধিকাংশ এখনো মাদরাসায় শিক্ষকতা করছে। আমিরুল মু’মিনিনের পক্ষ থেকে তাদের মন্ত্রীসহ সবার প্রতি নির্দেশ হলো- মাদরাসার শিক্ষকতা বহাল রাখতে হবে। শিক্ষকতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের খোস্ত প্রদেশের গভর্নরের সাথে কথা হলো, তিনি হেদায়া সানি (২য় খন্ড)পড়ান। সকালে হেদায়া পড়ান, এরপর সারাদিন তিনি গভর্নরের দায়িত্ব পরিচালনা করেন।

(সাম্প্রতিক আওয়ার ইসলামকে প্রদত্ত বক্তব্য অনুলিখন করেছেন: লাজ্জাস আল হাবিব)

Jubokantho24 Ad
এ জাতীয় আরো সংবাদ
এ জাতীয় আরো সংবাদ