আবদুর রহমান আদ দাখিল:
বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতিতে ওয়াজ-মাহফিলের অবতারণা সুপ্রাচীন। বহিরাগত ও স্থানীয় সুফি-সাধকদের হাত ধরে যখন থেকে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের সূচনা হয়, ওয়াজ-মাহফিল সংস্কৃতির শুরুটা বলতে গেলে তখন থেকেই। ধীরে ধীরে সময়ের পরিক্রমায় এর রূপ ও ঢঙে পরিবর্তন এসেছে, এর সাথে নতুন নতুন আচার-নীতি যুক্ত হয়েছে, এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নানান আঙ্গিকে বিবর্তিত হয়েছে, আর এভাবেই তা গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিতে এক আনন্দ মুখর উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বস্তুত বাংলাদেশের প্রান্তিক জনজীবনে ওয়াজ-মাহফিলের প্রভাব অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। শহর ও মফস্বলে যেখানে সকালের মক্তব ও মসজিদের ইমাম সাহেবের সাধারণ বয়ান ও নসিহতের মাধ্যমে ধর্মের মর্মবাণী সাধারণ শ্রেণির মাঝে প্রোথিত হয়, প্রান্তিক গ্রাম অঞ্চলে সেই জায়গাটি ছিল ওয়াজ মাহফিলের দখলে। এসব ওয়াজ-মাহফিলই গ্রামীণ কৃষক সমাজের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর হৃদয়ে ঈমানের ধিকি ধিকি আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে সর্বদা।
কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ওয়াজ মাহফিল এখন আর গ্রামীণ সংস্কৃতি নেই। মফস্বল থেকে শহরে, সবখানেই এখন মহা ধুমধামে মাহফিলের আয়োজন হয়। সেই সাথে ওয়াজ-মাহফিলের উদ্দেশ্য বা উপলক্ষেও এসেছে পরিবর্তন। আগে যেখানে ধর্মের মর্মবাণীর প্রচারই ছিল মূল লক্ষ্য, এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মসজিদ-মাদরাসার জন্য চাঁদা কালেকশনই হয়ে উঠেছে প্রধান নিমিত্ত। লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পরিবর্তন আসার পার্শ্বপ্রতিয়া হিসেবেই কি-না, এখন এসব ওয়াজ-মাহফিল কেন্দ্রিক নানান সমস্যা ও জটিলতা প্রায়শই সংবাদপত্রের শিরোনাম হতে দেখা যায়। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, অগ্রিম টাকা নিয়ে বক্তার মাহফিলে না আসা। কাছাকাছি সময়ে এমন অনেক অভিযোগ একাধিক অনলাইন-অফলাইন সংবাদমাধ্যমে চটকদার শিরোনামসহ উঠে এসেছে। তার জের ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় তৈরি হয়েছে নিন্দার ঝড়, যা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ওয়াজ-মাহফিল সংস্কৃতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এসব অভিযোগের পেছনে মূল দোষী করা, এর সূত্র কোথায় এবং প্রতিকার কী, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
টাকা নিয়ে বক্তার মাহফিলে উপস্থিত না হওয়ার অভিযোগ করে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যেন এর পেছনে বক্তারাই একমাত্র দোষী। কিন্তু এ বিষয়ক একাধিক প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। দেখা গেছে কেবল বক্তারাই নয়, ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত আরো তিনটি পক্ষের ভূমিকা রয়েছে এজাতীয় সমস্যার পেছনে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে বক্তা ও মাহফিলের আয়োজক কমিটির মধ্যকার যোগাযোগ স্থাপনকারী মধ্যসত্ত্বভোগী একটি শ্রেণির বিরুদ্ধে। এরা হতে পারে বক্তার পিএস বা পিএস পরিচয় দেওয়া প্রতারক কেউ, কিংবা মাহফিলের আয়োজক কমিটির পরিচিতি স্থানীয় মসজিদের ইমাম বা এমন কেউ। দেখা যায় তারা বক্তার সাথে যোগাযোগ না করেই নির্দিষ্ট ও প্রসিদ্ধ কোনো বক্তার নাম করে আয়োজকদের থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে মাহফিলের সময় লাপাত্তা হয়ে যায়।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার বাইতুল মামুর জামে মসজিদের ইমাম পরিচয় দানকারী মাওলানা এ বি এম শরিফুল ইসলাম নামের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ঢাকা পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে, তিনি নিজেকে জনপ্রিয় বক্তা মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদীর পিএস পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওয়াজ মাহফিল কমিটির কাছ থেকে নিতেন মোটা অংকের টাকা। কমিটির লোকজনকে আশ্বাস দিতেন তাদের ওয়াজ মাহফিলে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী। এভাবে দীর্ঘদিন প্রতারণার পর অবশেষে অভিযুক্ত আসামি গ্রেফতার হন।
অন্য এক সংবাদে জানা যায় নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে একদিন ব্যাপী ওয়াজ মাহফিলে প্রধান বক্তা হাফিজুর রহমান (কুয়াকাটা) না আসায় প্যান্ডেল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা অনুসন্ধানের পর উঠে আসে, স্থানীয় মসজিদের ইমাম হাফিজুর রহমান কুয়াকাটাকে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত করার আশ্বাস দিয়ে মাহফিল কমিটির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। মাহফিলের দিন দেখা যায় উল্লিখিত বক্তা উপস্থিত হচ্ছেন না আবার ইমাম সাহেবও লাপাত্তা। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর উপস্থিত জনসাধারণ ক্ষোভে মাহফিলের প্যান্ডেল ভাংচুর করে চলে যায়। পরে হাফিজুর রহমান কুয়াকাটার সাথে ফোনে যোগাযোগ করে ঘটনা জানানো হলে তিনি বলেন, তার সাথে সেই মাহফিলের বিষয়ে ইতোপূর্বে কেউ যোগাযোগ করেননি।
অপরদিকে অগ্রিম টাকা নিয়ে মাহফিলে উপস্থিত না হওয়ায় অভিযোগে সরাসরি বক্তার অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গত ১৯ ডিসম্বেরের কালের কণ্ঠ অনলাইন ডেস্কের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঠাকুরগাঁওয়ে অগ্রিম টাকা নিয়েও ওয়াজ মাহফিলে আসেননি বক্তা ইলিয়াসুর রহমান জিহাদী। তাঁর বিরুদ্ধে এ অভিযোগে মানববন্ধনও হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, উল্লিখিত বক্তা দুই দফায় ৮০ হাজার টাকা নিয়েছেন কিন্তু অসুস্থতার কথা বলে মাহফিলে উপস্থিত হননি। পরবর্তীতে মাহফিল কমিটি খবর নিয়ে জানতে পারে যে, তিনি বেশি অঙ্কের টাকা পেয়ে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুরে মাহফিল করেছেন।
এর বাইরে আয়োজক কমিটির ব্যাপারেও রয়েছে অভিযোগ। গত কিছুদিন আগে জুবায়ের আহমদ আশ্রাফী নামের এক বক্তার বিরুদ্ধে কোনো এক মাহফিল কমিটির একজন সদস্যের একটি বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল ভাইরাল হয়, যেখানে তাকে অভিযোগ করতে দেখা যায় যে, বক্তা জুবায়ের আহমদ আশ্রাফী একশ মোটরসাইকেলের শোডাউনের দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা না জানানোর জন্য কাছাকাছি এসেও মাহফিলের স্থল পরিত্যাগ করে চলে যান। বিষয়টি সামনে আসার পর উক্ত বক্তার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিন্তু পরেরদিনই বক্তা কোরআন হাতে নিয়ে এমন অভিযোগকে মিথ্যা বলে ঘোষণা দেন। নিজের দাবির পক্ষে তিনি নানান মুক্তি পেশ করেন। তিনি জানান, মূলত মাহফিলের কাছাকাছি যাওয়ার পরও তিনি আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে যথাযথ রেসপন্স পাচ্ছিলেন না। বারবার খোঁজ করেও তিনি মাহফিলের নির্দিষ্ট ঠিকানা কিংবা তাকে রিসিভ করার জন্য আয়োজকদের কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফলে রাগ করে তিনি মাহফিল প্রত্যাখ্যান করেছেন। বরং মাহফিল কমিটির বিরুদ্ধে তার উল্টো অভিযোগ ছিল তারা তার নাম ভাঙিয়ে মাহফিলের লোক বাড়িয়েছে, টাকা কালেকশন করেছে, এরপর তাকে যেন টাকা না দিতে হয়, এ জন্য নানান তাল-বাহানা করেছে।
এসব হচ্ছে কিছু খণ্ডচিত্র। এছাড়াও এমন নানান ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো কেন ঘটছে, এর প্রতিকার কী এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা এ নিয়ে কী ভাবছেন, এ ব্যাপারে শায়েখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম মাওলানা মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ এর নিকট মুঠোফোনের মাধ্যমে জানতে চাওয়া হলে তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে এ প্রসঙ্গে কথা বলেন। এসব সমস্যা নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ কী ভাবছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভাবনার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, বিভিন্ন দিক থেকেই বড়রা চিন্তা করছেন। বর্তমানে মাঠে-ময়দানে বক্তা, আয়োজক, শ্রোতাদের মধ্যে যেসব ঘটনা ঘটছে, এগুলোর সমাধান কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে বড়দের মধ্যে কিছু ফিকির চলছে, কিন্তু খুব জোরালো ফিকির চলছে না। কারণ হলো, জোরালো ফিকির করতে গেলে আশঙ্কা হচ্ছে, যারা এসব কাজে লিপ্ত, তারা আদৌ আলেমদের সন্মান দিবে কিনা, তাদের কথা মেনে নিবে কিনা, এখানে নিজের মানসিকতা, সামাজিক অবস্থান, বক্তার বক্তৃতার অবস্থান, এগুলোর দিকে তাকিয়ে আশঙ্কা হয়, মুরুব্বিদের কথা আদৌ তারা মেনে নিবে কিনা, সেজন্য প্রস্তাবটা জোরালো হচ্ছে না। তবে চিন্তা ভাবনা চলছে।’
কী ধরনের চিন্তা ভাবনা চলছে, তা স্পষ্ট করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দাওয়াতে ইসলামের সুন্নত তরিকার উপর বক্তাদের কিছু উপদেশ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে। এসব ছাড়া যে-কেউ বক্তা হয়ে যাওয়া, মাঠে ময়দানে বক্তৃতা দেওয়ার ফলেই মূলত নানান সমস্যা ঘটছে। সুন্নত তরিকায় দাওয়াতের জিম্মাদারিটা ওলামাদের উপর কতটুকু, দাওয়াতের তরিকা ও পন্থা-পদ্ধতি কী, কথার ভাষা কী, বক্তব্যের বিষয়বস্তু কী এবং সাহাবাদের যুগে, আসলাফ বুজুর্গদের যুগে, দেওবন্দি মাশায়েখ ও আকাবিরদের যুগে কীভাবে দ্বীনের দাওয়াতের কাজ তারা করেছেন মানুষের উপকার, ইসলাহ ও সংশোধনের জন্য— এসব বিষয় তুলে ধরে তাদেরকে আহ্বান করা, তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া, অনুরোধ করা, যাতে তাদের কারণে ইসলামের বদনাম না হয়, দ্বীনের এই বিভাগটা নষ্ট না হয়ে যায়, এটার জন্য খুব জরুরি ভিত্তিতে কিছু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে এটা করা হবে, আদৌ এটা করলে কোনো লাভ হবে কিনা, এসব বিষয়ে একটু চিন্তাভাবনা চলছে, তাই উদ্যোগটা জোরালো হচ্ছে না।’
এছাড়াও যেসব আলেম টাকা নিয়ে মাহফিলে উপস্থিত হচ্ছেন না, তাদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ জানান, ‘কোরআন হাদিসের সামান্য জ্ঞান যাদের আছে, তাদের কাছে এসব মানুষের অবস্থান পরিষ্কার। এ ব্যাপারে বড়ো আলেমদের কাছে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। কারণ টাকা নেওয়ার পর শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কোনো ওজর ছাড়া প্রোগ্রাম মিস করা একটি জঘন্য অপরাধ। প্রথম অপরাধ হচ্ছে ওয়াদা খেলাফি, হাদিসের আলোকে এটি হচ্ছে মুনাফিকের আলামত। এর আবার দুটি স্তর রয়েছে। কারো হয়তো টাকা নেওয়ার সময় শতভাগ নিয়ত ছিল মাহফিল করবে, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে এসে কোনো কারণে বাতিল করেছে, এটা তো গুনাহ অবশ্যই। তবে কেউ যদি টাকা নেওয়ার সময়েই মনে মনে রাখে যে, এরচেয়ে ভালো কোনো মাহফিল পেলে, বেশি টাকা পেলে সেখানে যাব, তাহলে এটা হবে সরাসরি কবিরা গুনাহ। অবশ্য কেউ যদি অগ্রিম টাকা নিয়ে মাহফিলে যাওয়ার কথা দেয়, কিন্তু গ্রহণযোগ্য শরঈ ওজরের কারণে উপস্থিত হতে না পারে, তাহলে মাহফিল কমিটিকে তাদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়াটা তার উপর ফরজ। অন্যথায় এটি হবে আমানতের খেয়ানত এবং হারাম ভক্ষণ, কোরআনের বিধান অনুযায়ী যা ভয়াবহ অপরাধ। গ্রহণযোগ্য শরঈ ওজরের কারণে মাহফিলে উপস্থিত হতে না পারার ক্ষেত্রে ওজরটি যদি তাৎক্ষণিক ঘটিত হয়, তবে কমিটিকে না জানালেও চলবে, যদিও সম্ভব হলে জানিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু যদি ওজর আগ থেকেই দেখা যায়, তাহলে অবশ্যই সেটা আয়োজকদের জানিয়ে দেওয়া জরুরি। অথচ এগুলো কিছুই করা হচ্ছে না। এর ফলেই নানান সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’
মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ বলেন, ‘এগুলো হচ্ছে বক্তাদের সমস্যা। এছাড়া আয়োজকদেরও কিছু ভুল রয়েছে। তারা এলাকার গান-বাদ্য শোনা, কনসার্ট করা, মেলার আয়োজন করা ইয়ং ছেলেদের রুচি ও পছন্দ মতো বক্তা আনে, যাদের ওয়াজ করার মতো যোগ্যতা ও অধিকার নেই। এরা কতক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করে, কতক্ষণ গজল সঙ্গীত গায়, কখনো আজান দেয়, একামত দেয়, নাচে, অভিনয় করে এবং এসবের মধ্যে ওয়াজ মাহফিলের মোবারক মঞ্চকে সর্বনাশ করে দেয়। তো যারা ওয়াজের নামে এসব কাজ করে, তারা যেমন দায়ী, অনুরূপ যারা ওয়াজের জন্য বহু টাকা খরচ করে এধরণের বক্তাদের দাওয়াত করে, এলাকার যুবক ছেলেদের সন্তুষ্ট করার জন্য, তারা আরও বেশি দায়ী। দুই পক্ষের কেউ এই দায় এড়াতে পারে না। এর দ্বারা দ্বীনের দুই পয়সার লাভ নেই। সময় নষ্ট, অর্থ নষ্ট, দাওয়াতের পরিবেশ নষ্ট— এর হেদায়েতের কোনো কাজ হয়না। সাধারণত এধরণের বক্তা ও আয়োজকদের মধ্যেই সমস্যাগুলো ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, আয়োজকরা বক্তাকে তেমন সন্মান ও শ্রদ্ধা করছে না। তারা মনে করছে টাকা দিয়েছি বিধায় বক্তা এসেছে, তাকে বাড়তি সন্মান করার কিছু নেই। টাকার বিনিময়ে সবকিছু হচ্ছে ভেবে কমিটি বক্তাকে নিজের কর্মচারীর মতো মনে করছে। এগুলো এখলাস পরিপন্থী কাজ। আয়োজকদের মধ্যেও এখলাস নেই, বক্তাদের মধ্যেও এখলাস নেই। এর ফলেই এসব সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। অন্যথায় মুখলিস আল্লাহওয়ালা বক্তাদের সাথে আয়োজকদের এমন সমস্যা হাজারে একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ হচ্ছে বিষয় আমার দৃষ্টিতে। তাই এগুলো সংশোধন হওয়া দরকার, এক্ষেত্রে একটা ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা থাকা দরকার বড়দের পক্ষ থেকে। নয়তো এদের কন্ট্রোল করতে না পারলে সামনের অবস্থা ভয়াবহ হবে। দাওয়াত, তাবলীগ, ওয়াজ, মাহফিল কিছুই থাকবে না।’
এ ধরনেরর অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে আয়োজকরা যথাযথ আইনের আশ্রয় নিতে পারে কিনা, কিংবা এজাতীয় দুর্ঘটনা এড়াতে শুরু থেকেই আইনি প্রক্রিয়ায় স্টাম্প লিখে সাক্ষী-সাবুদের মাধ্যমে চুক্তিনামা করে নিতে পারবে কিনা এবং এক্ষেত্রে শরিয়ত কী বলে এমন প্রশ্নের জবাবে মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ বলেন, ‘দ্বীনের দাওয়াত, দ্বীনী কাজ, এটা একটা নফল এবাদত, যাকে আল্লাহ্ তাউফিক দেয় সে করবে, আর যে পারে না সে করবে না। এটার কোনো বিনিময় হয়না। তবে আসা-যাওয়ার একটা খরচ আছে, একটা মানুষের কষ্ট আছে, ফলে বিনা শর্তে চুক্তি ছাড়া তাকে উপযুক্ত হাদিয়া দেওয়া উচিত। এই হাদিয়া দেওয়া ও কবুল করা উভয়টিই জায়েজ। তো যেহেতু দাওয়াতে তাবলীগ ও দ্বীন প্রচার এটা মালের বিনিময়ে জায়েজ নেই, তাই এখানে কোনো ধরনের কন্ট্রাক্টের সুযোগ নেই। যদি কন্ট্রাক্ট থাকত, তবেই-না আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা থাকত। যেহেতু এখানে কন্ট্রাক্ট নেই, আইনের প্রশ্নও নেই। আইন দিয়ে এই সমস্যা নিরসন করা যাবেনা, এটা নিরসন করতে হবে আখলাক দিয়ে, ইখলাস দিয়ে, আমল দিয়ে। ফলে কন্ট্রাক্ট ও চুক্তিপত্রের প্রশ্নই আসে না এখানে। হাদিসের ভাষায় এটাকে বলে ‘তাবাররু’, তথা স্বেচ্ছায় করণীয় দ্বীনের কাজ। এখানে কন্ট্রাক্ট বা চুক্তির কোনো অবকাশ নেই। এজন্য চুক্তি যারা করে, তাদের পক্ষে ওলামায়ে কেরাম নেই-ই, একদম নিষেধ চুক্তি করা। তবে কোনোরূপ চুক্তি ও কন্ট্রাক্ট ছাড়া বক্তা যদি জিজ্ঞেস করে, আমি এতদূর এত কষ্ট করে আসব, আমার পারপাসে আল্লাহর জন্য কেমন ব্যয় করতে পারবেন? এটা শুধু জানার জন্য জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, যেখানে সমস্যার আশঙ্কা হয় সেখানে। এটাকে কেউ কন্ট্রাক্ট বললেও এটা মূলত তেমন নয়, বরং এটা হচ্ছে ‘এলেম’, ‘নলেজ’ তথা জেনে রাখা। এটা বৈধ আছে। তবে এটাও এখলাসের পরিপন্থী। কিন্তু কখনো বিশেষ কোনো পরিবেশ, অবস্থা ও প্রেক্ষাপটে এটা করা যেতে পারে, কোনো সমস্যা নেই।’
মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ এর দীর্ঘ আলাপচারিতা একথার ইঙ্গিত দেয় যে, দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ এসব বিষয় নিয়ে অনেক আগ থেকেই ভাবছেন এবং এগুলো তাদের দৃষ্টির আড়ালে নেই। তবে নানান কারণে এ বিষয়ে তাদের পদক্ষেপ জোরালো হচ্ছে না এবং কার্যকারী উদ্যোগও নেওয়া যাচ্ছে না। আশা করা যায়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যদি আলেমগণ জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং পাশাপাশি তাতে বক্তা, শ্রোতা, ওয়াজ মাহফিলের আয়োজক কমিটিসহ সকল পক্ষের সমর্থন ও সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব থাকে, তাহলে এধরণের সমস্যা শতভাগ নিরসন করা সম্ভব। আর এমন হলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ওয়াজ মাহফিলের সুদিন আবার ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ।