শহীদুল ইসলাম
দেশের জিডিপি ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে। মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ারও বয়ান জোরেশোরে প্রচার করা হচ্ছে। চার দিকে শুধু উন্নয়ন আর উন্নয়ন। এমন একটা দেশে হঠাৎ যখন ডলারের মূল্য রেকর্ড পরিমান বেড়ে যায়, অস্বভাবিক মুদ্রাস্ফ্রীতি, নিয়ম করে বিদ্যুতের লোডশেডিং ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাইপে স্থায়ীভাবে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটে তখন মানুষের মাঝে কি অবস্থা তৈরি হতে পারে ? তারপর আবার রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির মুখ থেকে দুর্ভিক্ষের আগাম বার্তা। সে আতঙ্কের কম্পন ভূমিকম্প বা সিডরের ভয় দ্বারা পরিমাপ করা সম্ভব না। অবশ্য দুর্ভিক্ষের বিষয়কে পরে নাকচ করা হয়েছে। তবে টিসিবি পণ্যের ট্রাকে মানুষের লাইন দেখে অনেকে সেটাকে দুর্ভিক্ষের আলামত মনে করছেন। এ সব কারণে জনগণের কাছে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জৌলুস কমে এসেছে। তাছাড়া দূরাবস্থার মধ্য দিয়ে দুনীর্তি, সমন্বয়হীনতা ও পরিকল্পনার ঘাটতির বিষয়গুলোও একে একে সাধারণ মানুষের সামনে চলে এসেছে। সব মিলিয়ে ক্ষমতাসীনরা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় আছে। পত্রিকার সংবাদ মতে নতুনভাবে শরীকের খোঁজে নেমেছে তারা। অন্য শরীকরা এতে দ্বিমত। তাদের বক্তব্য চৌদ্দ দল কি একশ চল্লিশ দল হবে? তাই সাধারণ মানুষকে ক্ষেপানো বা নতুন কোন প্রতিপক্ষ তৈরি হোক তা তারা চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। তারপরও সরকার পাঠ্যবইয়ে কেন বিতর্কিত বিষয় সংযোজন করলো, যার আগ-পিছের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে? তাই রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিতভাবে এ বিতর্ক উস্কে দেয়া হয়েছে এমন সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলাম, ইসলামী শিক্ষা ও রাজনীতি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের অবস্থানকে সফলতা বা ব্যর্থতা উভয়টি বলা যায়। ব্যর্থতার কারণ স্পষ্ট। আওয়ামীলীগের উপর ইসলাম বিদ্বেষের ট্যাগ আছে। যা খোদ আওয়ামীলীগও উপলব্ধি করে। ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামীলীগ সরকার সে কলঙ্ক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মসজিদ ভিত্তিক মক্তব প্রতিষ্ঠা, কওমী মাদরাসার আদলে সরকারি খরচে দারুল আরকাম নামে সমন্বিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, মডেল মসজিদ নির্মাণসহ আরো বহু কাজ তারা করেছে। সে ক্ষেত্রে কওমী মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তারপরও সাধারণ মানুষের মনে ইসলাম নিয়ে আওয়ামীলীগের ব্যাপারে ধারণা নেতিবাচক। বর্তমান পাঠ্যবই বিতর্ক সাধারণ মানুষের সে ধারণাকে আরো দৃঢ়তা দিবে সেটাই স্বাভাবিক। সুষ্ঠু ভোট হলে নির্বাচনেও এর একটা প্রভাব থাকবে। যা আওয়ামীলীগকে অতিরিক্ত চাপে ফেলবে। কারণ শিক্ষার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতর আপত্তি রয়েছে। তারা মনে করে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা জরুরী। কিন্তু সরকার তাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। অপর দিকে পাঠ্যবইয়ে দিন দিন ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকুচিত করা হচ্ছে এবং যুক্ত করা হচ্ছে বিতর্কিত বিষয় যা নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন।
ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইসলামী রাজনীতি নিয়ে আওয়ামীলীগের দ্বিচারিতা রয়েছে। সেটাকে তাদের রাজনৈতিক সফলতা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। রাজনীতির ক্ষেত্রে ৯৬ এর মত আওয়ামীলীগ সব ইসলামী দলকে শত্রু বানায়নি। কিছু দলকে শরীক হিসেবে রেখেছে। কাউকে কাউকে বিরোধী হিসেবে দাড় করিয়ে তলে তলে বিভিন্ন সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে। আর কিছুকে নির্মূল বা কোনঠাসা করে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছে। এতে ২০০১ এর মত সবার চাপ তাদের সামাল দিতে হচ্ছে না। অনুরূপ শিক্ষাব্যবস্থায়ও তাদের দ্বিচারিতা প্রত্যক্ষ করা যায়। কিছু কিছু ইসলামী প্রতিষ্ঠানকে তারা ছাড়, সহযোগিতা দিয়ে নিজেদের পক্ষে রেখেছে। আর কোন কোনটিকে চাপে রেখে নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ মজবুত হয়েছে। এটাকে আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক সফলতা বলা যেতে পারে। আওয়ামীলীগের সফলতা বা ব্যর্থতার পাশাপাশি ইসলামপন্থিদেরও সফলতা বা ব্যর্থতার বিষয়টি ফুটে ওঠে। এত কিছুর পরও তাদের থেকে সফল কোন স্থায়ী বা অস্থায়ী উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। উদ্যোগ যা দেখা যায় তার গোড়ায় থাকে ক্ষমতাসীনদের এজেন্ডা। এতে কাজের কাজ কিছু না হলেও ক্ষমতাসীনরা ঠিকই স্বার্থ উদ্ধার করে নেয়।
গত এক যুগেরও বেশি সময় থেকে বাংলাদেশে রাজনীতি চর্চার কোন সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এককভাবে ক্ষমতাসীনদের হাতে। তাদের নাগালের বাইরে গিয়ে কেউ কিছু করতে পেরেছে বা করে রেহাই পেয়েছে এর নজির মিলানো ভার। দেশের বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও ব্যবসা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা নিয়ন্ত্রন করে আসছে। আন্তর্জাতিকভাবেও পরাশক্তিগুলোর সমর্থন তারা পেয়ে আসছে। এমনকি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত পরাশক্তিগুলোর সঙ্গেও তারা সুসস্পর্ক রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসায় এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে পশ্চিমারা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ায় স্বৈরাচারিদের বিপত্তি ঘটেছে। যার হাওয়া আমাদের দেশেও লেগেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সহ অন্যান্য দলগুলো ভোটের জন্য আন্দোলন শুরু করেছে। নিষেধাজ্ঞার ভয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহীনিকেও আগের মত ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাছাড়া মানবাধিকার ইস্যুতেও সামাজিক সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করতে পারছে। মোটকথা দীর্ঘ এক যুগ পর কিছুটা হলেও দেশে রাজনৈতিক আবহ তৈরি হয়েছে। তাই বর্তমান রাজনৈতিক আবহকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কৌশল হতে পারে পাঠ্যবই বিতর্ক উস্কে দেয়া। সরকারের ব্যর্থতাগুলো, অবাধ নিরেপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি, কিছু দিন যেতে না যেতেই সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সেবা বা পণ্যের মূল বৃদ্ধির মত বিষয়গুলোকে চাপা দিতেই হয়তো সরকার এ কৌশল নিয়েছে। পাঠ্যবই বিতর্ক সরকারের কৌশল হওয়ার যথেষ্ট আলামত রয়েছে। কারণ ইসলামী দলগুলোর যারা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেন তারাই এর বেশি প্রতিবাদ করছেন। অথচ আলেম উলামাদের মুক্তি ও অন্যান্য ধর্মীয় ইস্যুতে তাদেরকে খুব একটা সরব হতে দেখা যায় নাই। তাই সরকারের তরফ থেকে গ্রিন সিগনাল পেয়েই আন্দোলন হচ্ছে বলা যেতে পারে।
পাঠ্যবই বিতর্ক দেশের খন্ড একটা চিত্র। দেশের সামগ্রিক অবস্থার চিত্র নয়। দেশের সামগ্রিক অবস্থা আরো করুণ। সাধারণ মানুষের সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে মানুষের কথা বলার অধিকার হরণ করা হয়েছে। বিচার বিভাগগুলোকে কব্জায় নিয়ে বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে কোটি কোটি মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। তাই এ দেশের আলেম উলামাদের ইসলামী বিষয় নিয়ে সোচ্চার হওয়ার দায় যেমন আছে তেমনি দায় আছে দেশের সামগ্রিক দূরাবস্থা নিয়ে সোচ্চার হওয়ারও। মনে রাখতে হবে এ দূরাবস্থায়ও আলেম উলামারা যদি শুধু ধর্মীয় বিষয়গুলোতে সোচ্চার হয় আর বাকি বিষয় এড়িয়ে যায় তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। খুব বেশি দিন তো হয়নি হেফাজতের দাবির প্রেক্ষিতেই পাঠ্যবই থেকে এ বিষয়গুলো বাদ দেয়া হয়েছিল। কেন কিছু দিন যেতে না যেতেই আবার তা ফিরে আসল? এর মূল কারণ রাজনৈতিক স্বার্থ ও স্বেচ্ছাচারিতা। যতদিন রাজনৈতিকভাবে তাদের সামনে কোন চ্যালেঞ্জ তৈরি না হবে ততদিন তারা মানুষের অধিকার, অনুভূতিগুলোকে নিয়ে খেলা করেই যাবে। ক্ষমতার জোরেই যেহেতু তাদের এ সব অপকর্ম তাই ক্ষমতায় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয় এমন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। জনমত তৈরি করতে হবে।
ক্ষমতাসীনরা মন থেকে পাঠ্যবইয়ে এসব বিতর্কিত বিষয় সংযোজন করে থাকলে এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে ক্ষমতাসীন বা তাদের উপর সওয়ার হওয়া নাস্তিকদের মূল টার্গেট ইসলাম। ইসলাম ভিন্ন অন্য কিছু তাদের টার্গেট নয়। অন্যথায় যে সব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে তার সম্পর্ক ডিজিটাল বা স্মার্ট বাংলাদেশ কিংবা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কোনটির সঙ্গেই নেই। এগুলোর সম্পর্ক ইসলামী শিক্ষা ও মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে। মূল বিষয় হলো ইসলামকে ওরা সহ্য করতে পারে না। ইসলামের নামে যাই হোক বা যারাই করুক কোন কিছু ওদের টার্গেটের বাইরে নেই। সে ক্ষেত্রে ইসলামপন্থিদেরকে মধ্যম, কট্্রর বা উদার ভাগ শুধু সময়ের প্রয়োজনে। সময় ফুরালে কেউ রেহাই পাবে না।