সবচেয়ে দরকারি, সম্মানজনক ও শ্রেষ্ঠ ইলম হলো আল্লাহর সুন্দর নামগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন, যা অধিকতর সুন্দর অর্থ বহন করে এবং সবচেয়ে নিখুঁত, মহান ও উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন গুণের নির্দেশ করে। সবচেয়ে মহৎ বিষয় যা দ্বারা হূদয় আলোকিত হয় এবং অন্তর প্রফুল্ল হয় তা হলো- ওহির আলোকে আল্লাহর সুন্দর নাম ও মহান গুণাবলিকে জানা।
সুতরাং আল্লাহর ইবাদতকল্পে যে কেউ এগুলোকে স্বতঃস্ফূর্ততা, সন্তুষ্টি ও তুষ্টিসহ গ্রহণ করবে, আনুগত্যের সঙ্গে এর সামনে আত্মসমর্পণ করবে এবং এতে তার আত্মা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করবে, হূদয় প্রশান্ত হবে ও জ্ঞান শক্তিশালী হবে, তাহলে এর মাধ্যমে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস, প্রভুর প্রতি সম্মান বৃদ্ধি পাবে এবং স্রষ্টার প্রতি তার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তীব্র হয়ে উঠবে।
বস্তুত বান্দার সুখ ও সাফল্য নিহিত আল্লাহর সবচেয়ে সুন্দর নাম ও মহান গুণাবলির স্বীকৃতিতে। সুতরাং সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জানা, তাঁকে ভালোবাসা, তাঁর জিকির করা, তাঁর প্রতি খুশি থাকা, তাঁর নিকট অসিলা সন্ধান করা এবং তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার চেয়ে অন্তরের জন্য বড় কিছুর প্রয়োজন নেই।
এক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও বিশুদ্ধ সুন্নতে বর্ণিত তাঁর নাম ও গুণাবলি জানা ছাড়া বিকল্প আর কিছু নেই। তাই বান্দা যখন এ বিষয়ে অধিক জ্ঞানী হবে, সে আল্লাহ সম্পর্কে অধিক ভালো জানবে, তাঁরই নিকট বেশি নিবেদন করবে এবং তাঁরই অধিক নিকটবর্তী হবে।
আল্লাহর নামগুলোর মধ্যে রয়েছে— আল-আজিম (মহান), আল-মাজিদ (মহিমান্বিত), আল-মুতাকাব্বির (অহংকারী), আল-মুতায়ালি (পরম উচ্চ), আল-হাইয়ুল ক্বাইয়্যুম (চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক), যুল জালালি ওয়াল ইকরাম (মহিমা ও মর্যাদার অধিকারী), আল-ইলাহ (উপাস্য), আল-ক্বাহির (বিজয়ী), আল-ক্কাদির (সর্বশক্তিমান), আল-আলিইউল আ’লা (মহত্তম সত্তা), তাঁর সিংহাসনে তিনি প্রতিষ্ঠিত, তিনি এক ও অমুখাপেক্ষী। এই গুণাবলি হূদয়কে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, মহিমা ও ভয় দ্বারা পূর্ণ করে। তিনি মহিমান্বিত। তিনি ছাড়া কোনো আশ্রয় নেই। অতএব, বান্দা নিজের প্রয়োজন ও দোয়ায় শুধুমাত্র তাঁরই মুখাপেক্ষী হবে।
আল্লাহর নামগুলোর মধ্যে আরও আছে— আল-খবির (সর্বজ্ঞ) আল-লাতিফ (সূক্ষ্মদর্শী), আশ-শাহিদ (মহাসাক্ষী), আর-রাক্বিব (মহাপর্যবেক্ষক), আস-সামি (শ্রবণকারী) ও আল-বাছির (সর্বদ্রষ্টা)। এগুলো জমিনে বিচরণ বা অবস্থানকালে তাঁর পূর্ণাঙ্গ নজরদারি দিয়ে হূদয়কে পরিপূর্ণ করে এবং ইবাদতে দ্রুত অগ্রসর হওয়া ও পাপাচার থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জনের দিকে বান্দাকে পরিচালিত করে।
আর আল্লাহর নাম আর-রহমান (পরম করুণাময়), আর-রহিম (পরম দয়ালু), আল-বাররু (ন্যায়পরায়ণ), আল-কারিম (পরমদাতা), আল-জাওয়াদ (মহাদানশীল), আর-রাজ্জাক (রিজিকদাতা); এগুলো তাঁর প্রতি ভালোবাসা, তাঁর জন্য আকাঙ্ক্ষা, তাঁর রিজিক ও করুণা প্রত্যাশা এবং তাঁর প্রশংসা ও শুকরিয়ায় হূদয়কে পূর্ণ করে।
আর এভাবে যত বেশি আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কে একজন ব্যক্তির জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে, তত বেশি তার ঈমান, দাসত্ব, ভীতি, শ্রদ্ধা, বশ্যতা, অবনত হওয়া, আগ্রহ ও চাওয়া বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাকে সেসব নামেই ডাক।’ (সুরা আ’রাফ: ১৮০) তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই, সুন্দর নামসমূহ তাঁরই।’ (সুরা ত্বহা: ০৮) আর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর ৯৯টি নাম রয়েছে; যে তা আত্মস্থ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
‘যে তা আত্মস্থ করবে’, এর মানে হলো, নামগুলো মুখস্থ করা, সেগুলোর অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করা এবং তার দাবি ও বিধান অনুযায়ী আমল করা। উক্ত হাদিসটির মর্ম হলো, কোরআন ও সুন্নাহতে সাব্যস্ত হওয়া আল্লাহর নাম ও গুণাবলিকে বান্দা তার বাহ্যিক অর্থে আল্লাহর সঙ্গে উপযুক্তভাবে সাব্যস্ত করবে; কোনো ধরনের পরিবর্তন না করে, অর্থ অস্বীকার না করে, উপমা পেশ বা সাদৃশ্য না দিয়ে এবং মানুষের বিবেক অনুপাতে কোনো আকৃতি প্রদান করা ছাড়াই। কেননা তাঁর সত্তা ও গুণাবলির ধরন সম্পর্কে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ অবগত নয়। এটি এমন বিষয়ের অন্তর্গত যা আল্লাহ তায়ালা স্বীয় জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন। সুতরাং তা অবগত হওয়ার কোনো উপায় নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা আশ-শূরা: ১১) তিনি বলেন, ‘আপনি কি তাঁর সমনাম-গুণসম্পন্ন কাউকেও জানেন?’ (সুরা মারইয়াম: ৬৫) তিনি আরো বলেন, ‘এবং তাঁর সমতুল্য কেউই নেই।’ (সুরা আল-ইখলাস: ০৪) বস্তুত তিনিই উত্তম নাম, পূর্ণাঙ্গ ও সুন্দর গুণাবলি এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের বৈশিষ্ট্যাবলির ধারক।
অনুরুপভাবে কোরআন ও সুন্নাহতে যেসব বিষয় আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বান্দা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করবে এবং তাঁর বিপরীত বিষয়টি সাব্যস্ত করবে। যেমন- আল্লাহর সঙ্গে ‘জুুলুম’ সম্পৃক্ত করাকে প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জন্য ‘পূর্ণ ন্যায়পরায়ণতা’র গুণটি সাব্যস্ত করা এবং তাঁর থেকে ‘অক্ষমতা’ অপনোদন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জন্য পূর্ণ জ্ঞান ও ক্ষমতার গুণ সাব্যস্ত করা। কাজেই আল্লাহর নামসমূহ শব্দ, অর্থ ও মর্মগতভাবে জানা আবশ্যক এবং সেগুলোর দাবি অনুযায়ী আল্লাহর ইবাদত করা, সেগুলোর মাধ্যমে তাঁর নিকট প্রশংসা, ইবাদত ও প্রার্থনামূলক দোয়া করা আবশ্যক।
ইবাদতমূলক দোয়াতে যখন সে জানবে আল্লাহ আল-ক্বাবি (সর্বশক্তিমান), আল-মাতিন (মহাশক্তিধর), আল-আজিজ (মহাপরাক্রমশালী) ও আল-হাকিম (প্রজ্ঞাবান); তখন সে তার রবের ওপর তাওয়াক্কুল করবে, তার সৃষ্টিকর্তার নিকট আশ্রয় নেবে এবং সব মাখলুকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে; যাদের কোনো কামালিয়্যাত (পূর্ণতা বা কৃতিত্ব) নেই। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি ও সামর্থ্য নেই।
অনুরূপভাবে যখন সে জানবে যে তার রব আত-তাওয়াব (তওবা কবুলকারী), আর-রাহিম (অতিশয় দয়ালু), আল-গাফুর (ক্ষমাকারী) এবং আল-হালিম (পরম সহনশীল); তখন সে তার রবের নিকট তওবা করতে এবং তাঁর সৃষ্টিকর্তার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে দ্রুত অগ্রসর হবে।
আর যে ব্যক্তি জানবে যে তিনি আর-রাক্কিব (মহাপর্যবেক্ষক), আশ-শাহিদ (মহাসাক্ষী) আস-সামি (সর্বশ্রোতা), আল-বাছির (সর্বদ্রষ্টা), আল-লাতিফ (সূক্ষ্মদর্শী) ও আল-খাবির (মহাবিজ্ঞ); তখন এটি তার জন্য তার রবের অবাধ্য হওয়া থেকে ভয় এবং তার মাবুদের ব্যাপারে ডর করাকে আবশ্যক করবে। আর প্রার্থনামূলক দোয়া হলো প্রয়োজনের ধরনের সঙ্গে মিল রেখে তার রবের নাম ধরে দোয়া করা; যেমন এভাবে বলা: হে দয়াময়! আমার প্রতি দয়া করুন, হে ক্ষমাশীল! আমাকে ক্ষমা করুন, হে তওবা কবুলকারী! আমার তওবা কবুল করুন এবং হে রিজিকদাতা! আমাকে রিজিক দান করুন। আর নবীগণের অধিকাংশ দোয়া ছিল— ‘হে আমাদের রব!’ কেননা দোয়াকারীদের দোয়া কবুল করা, যাচনাকারীদের প্রদান করা, আশ্রয় প্রার্থনাকারীদের আশ্রয় দেয়া; এ সবগুলোই রুবুবিয়্যাতের অর্থ। তিনি আল-মুতাছররিফ (মহাপরিচালনাকারী), আল-ক্বাদির (মহাশক্তিমান), আল-মুদাববিরু (মহাপরিকল্পনাকারী), আর-রাজ্জাক (রিজিকদাতা) এবং আল-মু’তি (মহাদাতা); তিনি এমন ইলাহ একমাত্র যার নিকটই চাওয়া ও আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে উপকারী জ্ঞান ও সৎ আমলের তাওফিক দান করুন এবং আমাদেরকে সুপথপ্রাপ্ত ও সুপথ প্রদর্শনকারী করুন; পথভ্রষ্ট ও পথভ্রষ্টকারী নয়। আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, তোমরা আল্লাহ নামে ডাক বা রাহমান নামে ডাক, তোমরা যে নামেই ডাক সব সুন্দর নামই তো তাঁর।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ১১০)