সমতা (equality) আধুনিক ও আলোকিত পশ্চিমের পবিত্র মূল্যবোধের একটি। ফরাসি বিপ্লবী স্লোগান ‘স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব’ এবং স্বাধীনতার আমেরিকান ঘোষণাপত্র সমতা উদযাপন করার সময় দাবি করে যে, এটি একটি স্বজ্ঞাত ধারণা যে, সমস্ত মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং স্বাধীনতার মতো সীমাহীন অধিকার দেওয়া হয়েছে।[১] কানাডিয়ান চার্টার অফ রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমসও এ কথায় জোর দেয় যে, ‘প্রত্যেকেরই আইনের সমান সুরক্ষা, সমান সুবিধা ভোগ করার এবং আইনের চোখে সমান অধিকারের অধিকার রয়েছে। তার বিবেক, ধর্ম, চিন্তা-ভাবনা, মতপ্রকাশ এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংঘের মৌলিক অধিকার রয়েছে।[২]
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, যখন লেভেলারদের আন্দোলন (Levellers) সমতার আহ্বান জানায়, তখন এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল অভিজাতদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বাতিল করানো। পরবর্তী শতাব্দীতে, উদারপন্থীরা অর্থনৈতিক সুযোগের সমতার উপর জোর দিয়েছিল, যেখানে সকল মানুষের অগ্রগতি, সফলতা, সম্পদ এবং আয় লাভের ন্যায্য সুযোগ ছিল। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে সাম্য বলতে বোঝাত উৎপাদনের উপায়ের ওপর থেকে গুটিকয়েক লোকের একচেটিয়া আধিপত্য দূর করা এবং তাদের সবার প্রয়োজন পূরণের জন্য উন্মুক্ত করা। একুশ শতকে সমতার ধারণা এবং সংগ্রামকে সরল করে ‘ক্যাম্পেইন ফর ইকুয়ালিটি অফ রেজাল্টস’-এর রূপ দেওয়া হয়, যার অর্থ সবার জন্য সম্পদ, মর্যাদা এবং অবস্থানের সমতা। এটি নিপীড়িত শ্রেণির কণ্ঠস্বর নয়, বরং আমেরিকান ডেমোক্রেটিক পার্টির কণ্ঠস্বর, যারা নির্বাচনে স্লোগান দেয় , তাদের প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে ধনীদের কাছ থেকে আরও বেশি কর আদায় করা এবং তাদের ভোটারদের স্বার্থ-চাহিদা, রাস্তা, পাড়া, পার্ক এবং সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে ব্যয় করা। [৩]
কানাডার ব্রডবেন্ট ইনস্টিটিউট (Broadbent Institute) এর যুক্তি হলো, ‘অর্থনৈতিক বৈষম্য, আয় এবং সম্পদের অসম বন্টন আমাদের সময়ের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং ১৯৯০ এর দশকে কানাডায় যে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা আজও উচ্চ পর্যায়ে বিদ্যমান। এই প্রবণতাকে পরিবর্তনের জন্য প্রগতিশীলদের অবশ্যই এমন পাবলিক পলিসি দাবি করতে হবে যা সাধারণ সমৃদ্ধির উপর ফোকাস করে।’ একইভাবে, কানাডা সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভস বলে যে, ‘কানাডাকে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির একটি মোকাবেলা করতে হবে, এবং তা হলো আয় এবং সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধি।’ এই লক্ষ্যে, সংস্থাটি পরামর্শ দেয় যে, জনসংখ্যার সবচেয়ে ধনী 1% এর উপর উচ্চ করের সুযোগ রয়েছে। [৪]
আজকের যুগের সমস্যা হলো, স্ব-নির্মিত জীবনযাত্রার মানদণ্ডের প্রবক্তারা সমতা এবং অন্যান্য মৌলিক পশ্চিমা মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেনি, বরং সমতাকে অন্যান্য মূল্যবোধের উপরে রেখেছে। এর প্রধান কারণ হলো বিংশ শতাব্দীর বড় রাজনৈতিক আন্দোলন কমিউনিজম সাম্যকে তার রাজনীতির সবচেয়ে বড় আইডল করে তুলেছিল। কমিউনিস্টরা সাম্যের উপর এত জোর দিয়েছিল যে, এর জন্য কার্যতই স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির মূল্য চুকাতে হয়েছিল এবং অবশেষে পার্টি নেতারা তাদের শাসন বাঁচানোর জন্য জনগণ ও সাম্যকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।
অর্থনৈতিক সমতা বনাম ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
বিশ্বজোড়া সমাজের সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন দেখায় যে, অর্থনৈতিক সমতা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিপরীতভাবে সমানুপাতিক। যে সমাজে অর্থনৈতিক সমতা বিদ্যমান, সেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা অত্যন্ত সীমিত, এবং বিপরীতে, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতার উচ্চস্তর রয়েছে, সেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে। কারণটা বেশ স্পষ্ট। মানুষ স্বেচ্ছায় তাদের সম্পদ অন্যদের মধ্যে বণ্টন করে সমতা প্রতিষ্ঠা করে না। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধনী ব্যক্তিদের তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ কর আকারে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বাধ্য করে, যাতে তা সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা যায়। রাষ্ট্র এভাবে জবরদস্তির মাধ্যমে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সীমিত করে।
এই গবেষণাগুলো থেকে বোঝা যায় যে, সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক সমতা এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা সামঞ্জস্য বজায় রাখে না। একটির আধিক্যে অন্যটি হ্রাস পায়। পূর্ণ অর্থনৈতিক সমতার প্রবক্তারাও সমতা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপকে সমর্থন করে। বৃহত্তর অর্থনৈতিক সমতা অর্জনের উপায় হলো সরকার কর্তৃক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ এবং পুনঃবন্টন।[৫]
কমিউনিস্ট সমাজ যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন, মাও সেতুং-এর চীন, উত্তর কোরিয়া এবং কিউবা ইত্যাদি যেখানে অর্থনীতি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং স্বাধীনতা কমিউনিস্ট পার্টিগুলির আদেশ পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের বিপরীতে, উদার গণতান্ত্রিক সমাজের নির্দিষ্ট বহুত্ববাদ একাধিক দলে একাধিক নীতির সাথে দেখা যায়। উদার গণতন্ত্র অর্থনৈতিক সমতার সমর্থনে যথেষ্ট কিন্তু অপেক্ষাকৃত সীমিত স্বাধীনতার ব্যবস্থা সমর্থন করে, যেমন কল্যাণ রাষ্ট্র নীতি। বহুত্ববাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্রে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার মধ্যকার ভারসাম্যের বিষয়টি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়। কিছু দল বেশি সমতার উপর জোর দেয়, অন্যরা ব্যক্তি স্বাধীনতার সমর্থক। মোদ্দা কথা, বেশি সমতার পক্ষে কথা বলা আসলে কম স্বাধীনতার সমর্থন।
আরেকটি মূল্য যা বৃহত্তর অর্থনৈতিক সমতা বা সরকারের তরফ থেকে সমতা নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত ব্যবস্থা দ্বারা পরীক্ষিত হয়, তা হলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এই ইস্যুতে সর্বদা এই উত্তপ্ত বিতর্ক হয় যে, অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ফলশ্রুতিতে দুর্বল উত্পাদনশীলতা এবং উদ্ভাবনের অভাবের সম্মুখে পড়তে হয়। কমিউনিস্ট দেশগুলির অভিজ্ঞতা এমনই বলে, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে শ্রমিকরা এই বলে রসিকতা করত যে, ‘আমরা কাজ করার ভান করি এবং তারা আমাদের বেতন দেওয়ার ভান করে।’ কমিউনিস্ট ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে চীন পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পা দেয়। আসল প্রশ্ন হলো কাজ করার অনুপ্রেরণা, সুযোগ গ্রহণ এবং অর্থনৈতিক সুবিধার মধ্যে সম্পর্ক। এ এযাবৎকালের সাক্ষ্য-প্রমাণ বলে যে, উৎপাদন থেকে লাভবান হওয়ার স্বাধীনতা আরও উৎপাদনকে উৎসাহিত করে। বৃহত্তর অর্থনৈতিক সমতার পক্ষে ওকালতি করা প্রকৃতপক্ষে, কাজ এবং সমৃদ্ধির জন্য প্রণোদনার বিরুদ্ধে ওকালতি করার সমতুল্য।
লিঙ্গ সমতা (gender equality)
অতীতে, উদারপন্থীরা ব্যক্তিদের মধ্যে সমতার আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু আজকের প্রগতিশীলরা, যেমন কানাডিয়ান দার্শনিক উইল কিমলিকা (Will Kimlicka) ব্যক্তিদের বিভিন্ন ক্যাটাগরির (জেন্ডার, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষা, জাতীয়তা ইত্যাদি) মধ্যে সমতার দাবি জানায়। সমষ্টিগত সমতা এটি দাবি করে যে, প্রতিটি ক্যাটাগরির লোক বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ এই সমতা মানে অন্তর্ভুক্তি (inclusiveness)। পূর্ব এশীয়ান ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি ছাড়া স্কুলের ক্লাস, শিখ ছাড়া পুলিশ ফোর্স, আফ্রিকান আমেরিকান ছাড়া সিটি কাউন্সিল, ইতালীয়দের ছাড়া সিভিল সার্ভিস, মুসলিম ছাড়া অফিস, সমকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার ছাড়া কোম্পানির বোর্ড অসম্পূর্ণ, বর্ণবাদী এবং অন্যায্য বলা হয়। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যত বেশি সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, ততই তাদের সমতাবাদী ও ন্যায়পরায়ণ বলা হবে।
আপাতদৃষ্টিতে বলা হয়, লিঙ্গ সমতার মানে হলো পুরুষ ও নারীকে সমান সুযোগ এবং অংশগ্রহণ প্রদান করা। কিন্তু বাস্তবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০% শিক্ষার্থী নারী এবং আইন ও চিকিৎসা ক্ষেত্রেও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সর্বত্র এই কুশেশ চলে যে, পুরুষ এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ রাখে এমন লোক যত কম হবে, ততই ভালো। ডাকোটা নিউম্যানের (Dakota Newman) মতে লিঙ্গ সমতাও একটি সমস্যাজনক টার্ম, কারণ এর কোনো সাধারণ সংজ্ঞা নেই এবং অনেক মতলব এর হতে পারে। [৬]
জেন্ডার-ইকুয়ালিটি বা লিঙ্গ সমতা মানে লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত উপায়, সম্পদ এবং সুযোগ, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, মূল্য এবং মর্যাদা, অধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহ বিভিন্ন আচরণ, ইচ্ছা এবং চাহিদার সমান অ্যাক্সেস। এটির লক্ষ্য হলো নীতি ও আইনে পরিবর্তন আনা, যাতে লৈঙ্গিক স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয় এবং বিশ্বব্যাপী যৌন পাচার, নারী হত্যা, যৌন সহিংসতা , শ্রেণীগত বেতনের ব্যবধান এবং অন্যান্য ধরণের যৌন নিপীড়ন অবসিত হয়। নারীদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, মালিকানা, সম্পত্তি, ক্রেডিট, ইত্যাদিতে অধিক প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। লিঙ্গ সমতা অর্জন জাতিসংঘের ১৭ টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের পঞ্চমতম এবং এটাকে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন (Human Development Reports) দ্বারা প্রতি বছর পরিমাপ করা হয়। [৭]
লিঙ্গ সমতায় জাতিসংঘের ভূমিকা
লিঙ্গ সমতা শুধু নারী-পুরুষের সমতা নয়, এটি বিশ্বব্যাপী বাইনারি লিঙ্গ-ভিত্তিক (নারী ও পুরুষ) সমাজের অবসান ঘটানোর একটি প্রচেষ্টা, যেখানে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ খিলাড়ি হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। কয়েক দশক আগে, শব্দটি জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই শব্দটি ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের পরিচয়কে আইনত সুরক্ষা এবং প্রচার করতে ব্যবহৃত হয়, যা তাদের জন্মগত শরীর থেকে প্রকাশ পায় না। ২০১৯ সালে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল একটি রেজুলিশনে এই শব্দটিকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে যে, পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে ব্যবধান দূর করার আন্তর্জাতিক এজেন্ডা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের এই রেজুলেশনে ইন্টারসেক্স ক্রীড়াবিদদের অনুমতি দেওয়া হয় যে, তারা নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং এটাকে তাদের অধিকারের সুরক্ষা ঘোষণা করা হয়। একইভাবে, জাতিসংঘের অন্যান্য রেজুলেশনে যেখানে লিঙ্গ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এর অর্থ হলো, লৈঙ্গিক পতাকার অধীনে এমন পুরুষদের অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষা উদ্দেশ্যে, যারা তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এর মধ্যে ট্রান্সজেন্ডারের পাশাপাশি queer, intersex, pan sexual, gender non confirming, nonbinary এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যের সম্পূর্ণ পরিসর অন্তর্ভুক্ত আছে। লিঙ্গের পরিভাষাটি এমন এক অস্ত্র যাকে নারীর নামে পরিবারকে ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রতি বছর, জাতিসংঘের Sustainable Development Goals এর জন্য বরাদ্দ করা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার নারী অধিকারের নামে এই লিঙ্গ মতাদর্শ প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমরা মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, বোন, ভাইয়ের মতো শব্দ শুনে এসেছি যা একটি পরিবার গঠন করে, কিন্তু এখন সেগুলোকে লিঙ্গ সমতার নির্মম যানের চাকার নিচে পিষ্ট করা হচ্ছে। এই এজেন্ডা সফল হওয়ার সাথে সাথে নারীরা সে-সমস্ত অধিকার হারাবে, যা শত শত বছরের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে। [৮]
সমতা না অভিন্নতা?
ফরাসি রাজনৈতিক দার্শনিক অ্যালাইন ডি বেনোইস্ট (Alain de Benoist) বলেন যে, লিঙ্গ তত্ত্বে, সমতাকে অভিন্নতা (sameness) হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, অথচ এই ব্যাখ্যাটি, স্পষ্টতই নারী বিরোধী। এই ব্যাখ্যায় এটা অনুমান করা হয় যে, সোসাইটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তাতে সমস্ত পেশা-বৃত্তি, সম্পর্ক, চুক্তি এবং অনুষঙ্গগুলি তার নিজস্ব ইচ্ছা এবং স্বায়ত্তশাসন দ্বারা নির্ধারিত হয়। সুতরাং, নারীর পরিচয়কেও তাদের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত, কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে নয়। অর্থাৎ, যেকোনো মূল্যেই নারীদের নিজেদেরকে নারী হিসেবে বিবেচনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সমতার এই ধারণাটির জন্য অভিন্নতা প্রয়োজন এবং এটি আসলে জ্যাক দেরিদার (Jacques Derrida) বাইনারি শ্রেণীবিভাগের (binary oppositions and binary pairs) ধারণা থেকে নেওয়া হয়েছে। দেরিদার মতে, দিন/রাত্রি, উপস্থিতি/অনুপস্থিতি, পুংলিঙ্গ/স্ত্রীলিঙ্গ ইত্যাদির মত বাইনারি শ্রেণীবিভাগে, সর্বদা একটি শব্দের অন্যটির উপর আধিপত্য করার প্রবণতা থাকে, অর্থাৎ দিন ছাড়া রাত, উপস্থিতি ছাড়া অনুপস্থিতি এবং পুংলিঙ্গ ছাড়া স্ত্রীলিঙ্গের কল্পনা করা যায় না। নারীবাদী বিশেষজ্ঞরা এর থেকে এই উপসংহার টেনেছেন যে, এই আগ্রাসী এবং সহিংস প্রবণতাকে অবশ্যই প্রতিরোধ করা উচিত। এইভাবে, উগ্র নারীবাদী আন্দ্রেয়া ডোয়ার্কিন, (Andrea Dworkin) তার বিশ্বাস এবং মতাদর্শে, “পুরুষ আধিপত্য এবং লিঙ্গকে খতম করার দৃঢ় সংকল্প” প্রকাশ করে। ফরাসি নারীবাদী মনিক উইটিগ (Monique Wittig) বলে যে, আমাদের রাজনৈতিক, সিম্বোলিক এবং দার্শনিকভাবে নারী ও পুরুষের ক্যাটাগরিকে ধ্বংস করতে হবে এবং উভয়কে সমতা তথা অভিন্নতার স্তরে নিয়ে আসতে হবে, যাতে কেউ আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। তার দৃষ্টিতে, পরিচয়ের প্রকাশ এবং আকাঙ্খার স্বাধীনতা দাবি করে যে লিঙ্গ বিভাগগুলি বিলুপ্ত করা উচিত, কারণ যতক্ষণ এই বিভাগগুলি বিদ্যমান থাকবে, একজন নারীর পরিচয় একজন পুরুষের উপর নির্ভর করবে।[৯]
মনিক হুইট্যাগ এই বিষয়টাও ঘৃণা করত যে তিনি একজন নারী লেখিকা। তাই সে নিজেকে একজন র্যাডিক্যাল লেসবিয়ান রাইটার বলত। তার ধারণা যে, লেসবিয়ানরা নারী নয়, কারণ তারা নারীদের ক্যাটাগরির বাইরে পড়ে এবং লেসবিয়ানদের সাথেই সম্পর্ক রাখে। তাদের নিজের অস্তিত্ব স্বীকার করানোর জন্য কোনো পুরুষের প্রয়োজন নেই। হাস্যকরভাবে, সমান অধিকারের সংগ্রামে এবং পুরুষত্বকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টায়, নারীত্ব নিজেই পুরুষত্বের রূপ গ্রহণ করে নিলো এবং এখন প্রকৃত নারী তাকে মনে করা হয়, যিনি একজন পুরুষের রূপ ধারণ করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সমতাবাদী ফেমিনিজমের নারী-বৈচিত্র্যের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই, কারণ নারী বৈচিত্র্যের মধ্যে পার্থক্যের ধারণা বিরাজ করে এবং নারীবাদ জৈবিক পার্থক্যও বিদূরিত করতে চায়। [১০]
সমতার মূল্য বা দায়শোধ
বর্তমানে যে সমষ্টিগত সমতার এজেন্ডা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, তার জন্য দুনিয়ার সমাজগুলো ভারী মূল্য চুকাচ্ছে। একটি মূল্য হলো স্বতন্ত্র পরিচয় হারানো, যেখানে জাতিগত, জাতীয়, ধর্মীয়, যৌন ক্যাটাগরিগুলো ব্যক্তিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্ব, সংশ্লিষ্ট ক্যাটাগরির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। নির্দিষ্ট কিছু কাজে সামর্থ্য ও যোগ্যতার অভাবের আকারে চুকাতে হয় দ্বিতীয় মূল্য। লোকদের কাজ করার ক্ষমতার অগ্রাধিকারের চেয়ে, কেবল তাদের জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ইত্যাদির কারণে বেছে নেওয়া হয়। এইভাবে, সংশ্লিষ্ট কারণগুলিতে মনোযোগ না দেওয়ার কারণে কম সামর্থ্যযুক্ত লোকেরা উপরে উঠে যায়। অতঃপর এ ধরনের বাক্য শুনতে পেতে হয় যে, ‘আচ্ছা, আপনি স্নাতক পর্যায়ে খুব ভালো স্কোর করেছেন, কিন্তু আমাদের ইতিমধ্যে একজন শিখ কর্মী আছে এবং এখন আমাদের একজন সমকামী বা লেসবিয়ান ওয়ার্কারকে নিয়োগ করতে হবে।’ অন্য কথায়, ক্যাটাগরির লেবেলগুলির কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য প্রবণতা, ক্ষমতা এবং সম্ভাবনা গুরুত্বহীন হয়ে যায় এবং লোকেরা কেবল ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্তির কারণে সাফল্য অর্জন করে নেয়। এইভাবে সমষ্টিগত সমতার প্রবক্তারাও প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি পরিচয়, যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠতা (excellence) সন্ধানের বিরোধী। আপনার এমন সুধারণায় পড়ে প্রতারিত হওয়া উচিত নয় যে, সমতা প্রচারের প্রোগ্রামগুলো মুফত এবং উপকারী। আপনাকে স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি, স্বাতন্ত্র্য, যোগ্যতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের বিলুপ্তির আকারে এ-সবের ভারী মূল্য দিতে হবে।[১১]
এমন একটি কোম্পানির কল্পনা করুন যেখানে সবাই সমান। কোনো ম্যানেজার, সুপারভাইজার বা দারোয়ান ইত্যাদি নেই, সবাই একই কাজ করে এবং কেউ কাউকে রিপোর্ট করে না। তারা যাই পরিশ্রম করে বা যতই দক্ষ হোক, সবাই সমান বেতন পায়। সবার কাজের সময় একই। সমতা বজায় রাখা কঠিন হতে পারে বলে কেউ কখনও পদোন্নতি পায় না। আপনি কি মনে করেন যে, এই ধরনের একটি কোম্পানি সফল হবে? স্পষ্টতই নয়, কারণ সমাজ সর্বদা বিশেষীকরণে সমৃদ্ধ হয়। একজন একাকী ব্যক্তি যেভাবে চায় জীবনযাপন করতে পারে, তবে সমাজে যোগদানের পরে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিবিন্যাস অনুসরণ করা আবশ্যক। সবাই ‘আলফা’ হতে পারে না এবং সবাই ‘আলফা’ হওয়ার চেষ্টা করলে সমাজ ব্যর্থ হবে। সাম্যের স্লোগান একজন ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তির কাছে আবেদনময় হতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণ সমতা সমাজের কার্যকারিতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। সমাজের টিকে থাকার জন্য আদল ও ইনসাফ, সাম্য ও ন্যায়বিচার অপরিহার্য, কিন্তু শ্রেণীর মধ্যে সম্পূর্ণ সমতা প্রতিষ্ঠার দ্বারা সমাজ কার্যকরভাবে ক্রিয়াশীল হতে পারে না।
পূর্ণ সমতার মাধ্যমে যখন সমান ফলাফল নিশ্চিত করা হয়, তখন শুধু ধর্ম, বিশ্বাস, সভ্যতা, শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য, অনুভূতি নয়, জীবনের সব রঙ নষ্ট হয়ে যায়। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা যুক্ত হয়। যুবকরা বুঝতে পারে না কার সাথে বন্ধুত্ব করবে এবং কাকে বিয়ে করবে। কারণ একটি নিশ্চিত পরিস্থিতির জন্য যে উৎসাহ প্রয়োজন, তা সমতার দ্বারা লুপ্ত হয়ে যায়৷ সম্পূর্ণ সমতা পারিবারিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে এবং প্রতিটি বিষয় বাণিজ্য ও দর কষাকষির নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। আবেগ, সম্পর্ক ও ভালোবাসা ছাড়া ঘর হয়ে যায় কম্পিউটারের অ্যালগরিদমের মতো। ফলে শিশুরা তাদের বাবা-মাকে হত্যা করে বা বাড়ির বড়দেরকে মাহরাম সম্পর্কের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায় এবং জীবন একটি ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।[১২]
তথ্যসূত্র:
[১] “The Declaration of Independence” The Want, Will and Hopes of the People. Retrieved from https://www.ushistory.org/DECLARATION/document/
[২] “The Constitution Acts of Canada 1867 to 1982”. Retrieved from https://laws-lois.justice.gc.ca/PDF/CONST_TRD.pdf
[৩] “Let’s end corruption – starting with Wall Street” New Internationalist magazine issue 447. Retrieved from https://web.archive.org/web/20131102012454/http://newint.org/features/2011/11/01/wall-street-corruption-protests/
[৪] “Growing Gap” CCPA. Retrieved from https://www.policyalternatives.ca/projects/growing-gap
[৫] Kymlicka, Will (1996) “Multicultural Citizenship: A Liberal Theory of Minority Rights”. Retrieved from https://www.amazon.ca/Multicultural-Citizenship-Liberal-Theory-Minority/dp/0198290918/ref=sr_1_4?ie=UTF8&qid=1486600545&sr=8-4&keywords=kymlicka
[৬] “Women in Canada embrace higher education”. Retrieved from https://www.macleans.ca/education/uniandcollege/women-in-canada-embrace-higher-education-statcan-survey/
[৭] McKie, Linda & Jeff Hearn (2004) “Gender Neutrality and Gender Equality: Comparing and contrasting policy responses to Domestic Violence in Finland and Scotland”. Retrieved from https://web.archive.org/web/20131021023708/http://www.scottishaffairs.org/backiss/pdfs/sa48/sa48_McKie_and_Hearn.pdf
[৮] Ells, Kimberly (2021) “The Dark Side of Global Gender Equality”. Retrieved from https://www.dailysignal.com/2021/01/27/the-dark-side-of-global-gender-equality/
[৯] Kirkup, James(2003) “Monique Wittig”. The Independent https://web.archive.org/web/20071001031550/http://news.independent.co.uk/people/obituaries/article123410.ece
[১০] Mattix, Micah (2015) “The Absurdity of Gender Theory”. Retrieved from https://kirkcenter.org/reviews/the-absurdity-of-gender-theory/
[১১] Salzman, Philip Carl (2018) “Equality at What Cost?”. Retrieved from https://fcpp.org/2018/04/14/equality-at-what-cost/#_ftnref5
[১২] Chamberlain, Shannon (2014) “What is the price of Perfect Equality?”. Retrieved from The Atlantic https://www.theatlantic.com/business/archive/2014/08/what-is-the-price-of-perfect-equality/378621/