রাকিবুল হাসান নাঈম:
যে সময়ে বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের জন্ম, উপযুক্ততার বিচারে ইসলামের স্বপক্ষে কথা বলার জন্য তখন এমন একটি সংগঠনের বড্ড প্রয়োজন ছিল। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের পর এর একটা জ্বলন্ত প্রমাণ আমরা দেখতে পেয়েছি। ২০১০ সালে জন্ম নেয়া হেফাজতে ইসলাম একটু একটু করে পরিণত হয়েছে। নয়ত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে এত বড় আন্দোলন হুট করেই সম্ভব ছিল না। এই লেখায় হেফাজতে ইসলামের সূচনা, বিকাশ এবং বিভক্তির সরল বিবরণ তুলে ধরবো। তুলে ধরবো দলীয় কমিটিতে ভাঙা-গড়া ও মান-অভিমানের খণ্ডচিত্র। কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, ইতিহাসের কাছে একটা বয়ান রেখে যাবার সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র।
যেভাবে তৈরি হলো প্রেক্ষাপট
২০০৯-১০ সালে বাংলাদেশে জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় বড় তিনটি ঘটনা ঘটে। তিনটি ঘটনাই এদেশের মুসলমানদের জীবনাচার এবং ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
১. জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সর্বপ্রথম শিক্ষানীতিটি (১৯৭২-৭৪) প্রণয়ন করেছে ডা. কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশন। কিন্তু ধর্মীয় ভাবধারার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে জনগণ কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যাত, ধিকৃত ও নিন্দনীয় হয়। এ শিক্ষা কমিশন নব্বইটি প্রশ্ন সম্বলিত একটি প্রশ্নমালা, শিক্ষামালা—শিক্ষক, ছাত্র ও এমপিসহ মোট ৯৫৫১ জনের কাছেকাছে প্রেরণ করেন। উত্তর দেন ২৮৬৯ জন। উত্তরদাতাদের মাঝে ২২৮৫ জনই মাধ্যমিক অথবা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ধর্ম শিক্ষাকে বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। ধর্ম শিক্ষাকে তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন মাত্র ১১৬ জন। অন্যরা এ ব্যাপারে কোনো মতামত দেননি। একইভাবে মাদরাসা শিক্ষার প্রয়োজন নেই—এ মত দেন মাত্র ৭৬ জন। ৭২২ জন মাদরাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে একীভূত করার পক্ষে মত দেন। অন্যরা মত দেন মাদরাসা শিক্ষাকে বহাল রাখার পক্ষে। তবে মজার ব্যাপার হল, এর কোনোটারই প্রতিফলন ঘটেনি ড. কুদরতে খোদা কমিশনের রিপোর্টে।
২০০৮ সালে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়ন করে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি। এই শিক্ষানীতি প্রণীত হয় ১৯৭২ এর ডা. কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশনের ওপর ভিত্তি করে। এতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল ৪-এ বলা হয়, ‘মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত সকল ধর্মের শিশুদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান, অক্ষর জ্ঞান-সহ আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিকতা শিক্ষা প্রদানের কর্মসূচি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে।’ এ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূলত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাদরাসা ও স্কুলে ধর্ম না পড়িয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা প্রভৃতি উপাসনালয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রদানের কথা বলা হয়েছে। বস্তুত, এর মাধ্যমে ধর্ম শিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার কৌশল অবলম্বন করা হয়।
২. নারী নীতি ২০১১
২০১১ সালের ৮ মার্চ সরকারের নিয়মিত মন্ত্রীসভায় মহাজোট সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ (National Women Development Policy, 2011) নামক নীতিটি অনুমোদন করে। এই নীতিটি প্রণীত হয় ১৯৯৭ সালের নারী নীতির আলোকে। ১৯৯৭ সালে নারী উন্নয়ন নীতিতে নারী-পুরুষের সমান উত্তরাধিকার দেয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার এতে কিছুটা পরিবর্তন করে। যেমন—সম্পত্তি, ভূমি ও উত্তরাধিকারে সমঅধিকার (equal rights) শব্দগুলো বাদ দেয়া হয়। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭-এর নীতিকে আবার প্রায় অক্ষরে অক্ষরে গ্রহণ করা হয়। তবে সমঅধিকারের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার (Inheritance) শব্দের স্থলে স্থাবর-অস্থাবর (Moveable and Immoveable Property) সম্পত্তি কথাটি যোগ করা হয়।
৩. সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস’ তুলে দেয়া
সমাজতন্ত্রবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র—এ চারটি মূলনীতির আলোকে ১৯৭২ সালে প্রণীত হয় বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। এরপর সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ নীতিটি বাদ দিয়ে তার স্থলে আনা হয় ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। কিন্তু ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়। তারপর ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৫ম সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ এই বাতিল ঘোষণার মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ছুঁড়ে ফেলা হয় ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’-এর নীতিটি।
হেফাজতে ইসলামের জন্ম
একদিকে জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ধর্মশিক্ষাকে আলাদাকরণ, অন্যদিকে কুরআনবিরোধী আইন প্রণয়ন, তার সঙ্গে সংবিধানের সূচনা থেকে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তুলে ফেলার ষড়যন্ত্র—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম উম্মাহর আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে আলেমদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদও হচ্ছিল জায়গায় জায়গায়। কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ খুব উল্লেখযোগ্য হয়ে কখনোই দেখা দেয় না। আর সব রাজনৈতিক দাবির মতোই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বিশেষ বিশেষ দাবিগুলো। ঠিক এই সময়, ১৭ জানুয়ারি ২০১০, আল্লামা আহমদ শফির আমন্ত্রণে হাটহাজারি মাদরাসায় একত্রিত হন চট্রগ্রামের বড় বড় মাদরাসার শিক্ষক এবং মুহতামিমগণ। এই প্রেক্ষাপটে কিভাবে প্রতিবাদ জানানো যায়, কিভাবে ধেয়ে আসতে থাকা অধার্মিকতার স্রোতকে ঠেকানো যায়, তা-ই আলোচ্য বিষয়। কিন্তু সেদিন চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। প্রাথমিক আলোচনার পর শেষ হয় বৈঠক।
১৯ জানুয়ারি আবারো বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকে আল্লামা আহমদ শফি প্রস্তাব করেন, ‘লালদিঘির ময়দানে আমরা একটি সমাবেশ করতে চাই। সমাবেশ থেকে প্রতিবাদ জানানো হবে।’ মাওলানা আবদুল হালিম বুখারী তখন জানতে চান, ‘কোন ব্যানারে সমাবেশ করা হবে। যেকোনো একটি ব্যানারে তো সমাবেশ করতে হবে।’ আলোচনায় একটি সংগঠনের প্রস্তাব উঠে আসে। যেটি হবে নিরেট অরাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনের ব্যানারেই ২৪ জানুয়ারি লালদিঘির ময়দানে সমাবেশ হবে।
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘সংগঠনের নাম হিসেবে প্রথমে পুরাতন ইসলামি সংগঠনের নামগুলো প্রস্তাবে উঠে আসে। তার মধ্যে অন্যতম ‘ইসলামি আইন কমিটি’। কিন্তু প্রস্তাব প্রস্তাবই থেকে যায়। সবাই তখন একমত হয়, নতুন নাম হলেই ভালো হয়। তাহলে পুরাতন সংগঠনের নেতিবাচক প্রভাবগুলো থাকবে না। নিখুঁত নতুন একটি নাম হলে উদ্যম এবং উদ্দেশ্যেও দৃঢ়তা এবং দৃপ্ততা পাওয়া যাবে। মাওলানা আবদুল হালিম বুখারি সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন, ‘সংগঠনের নাম হোক হেফাজতুল ইসলাম।’ মাওলানা সুলতান যাওক নদভি বললেন,‘হেফাজতুল ইসলাম নামটি আরবি। মানুষের উচ্চারণে সমস্যা হতে পারে। যদি নামটি ফার্সিতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ বলা হয়, তাহলে সমস্যাটা থাকবে না।’
হেফাজতে ইসলাম নামটিই গৃহীত হলো। সবাই আল্লামা আহমদ শফি দা.বা.কে আবেদন করল, ‘আপনি হবেন হেফাজতে ইসলামের আমীর।’ তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার বয়স পড়ে গেছে। গায়ে এত শক্তিও নেই এবং সংগঠন পরিচালনার তেমন অভিজ্ঞতাও নেই। মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী হোক আমির।’ মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী রাজি হলেন না। বরং বললেন, ‘হজরত, আপনিই আমির হবেন। আমি না হয় আপনার সহকারী হিসেবে থাকব।’ এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না মুফতি আবদুর রহমান রহ.। তাকে বৈঠক থেকে ফোন করে জানানো হল, ‘আল্লামা আহমদ শফির নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন করা হয়েছে। সিনিয়র নায়েবে আমির হিসেবে আপনাকে রাখতে চাচ্ছি।’ তিনি বললেন, ‘আল্লামা আহমদ শফি সাহেব হুজুর যে কাজই করেন, আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে তার সঙ্গে কাজ করব।’
প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হল। আমির আল্লামা আহমদ শফি। নায়েবে আমির—মাওলানা আবদুল হালিম বুখারী, আল্লামা জমিরুদ্দিন নানুপুরী, মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, আল্লামা আবদুল মালেক হালিম। সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি আবদুর রহমান। মহাসচিব মাওলানা সুলতান যাওক নদভি। যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি।
প্রথম ভাঙন, প্রথম সমাবেশ
২৩ জানুয়ারি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় লালখান বাজার মাদরাসার মুহতামিম মুফতি ইজহারুল হকের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের সমালোচনা করেন এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমর্থন ব্যক্ত করেন। তখন তিনি আওয়ামীলীগের সঙ্গেই ছিলেন এবং দলীয় প্রতীক নৌকাকে নূহ আ. এর নৌকা বলে সমালোচিতও হয়েছিলেন আগে। আচমকা তার এই প্রত্যাবর্তন ও সমর্থনে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন মাওলানা আবদুল হালিম বুখারী ও সুলতান যাওক নদভি। তারা আল্লামা আহমদ শফিকে বলেন, দৈনিক পত্রিকায় তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে । বিবৃতিতে বলা হবে, মুফতি ইজহারুল হককে আমরা আওয়ামীলীগ থেকে আসতেও বলিনি এবং হেফাজতে ইসলামে যোগ দিতেও বলিনি। কিন্তু আল্লামা আহমদ শফি সাহেব বললেন, ‘মুফতি ইজহারের সঙ্গে আমার বাক-বিতণ্ডা হয়নি। সে তার জায়গা থেকে বিবৃতি দিয়েছে। তার ওপর সে আমার ছাত্র সমতুল্য। এভাবে তার বিরুদ্ধে মাঠে-ময়দানে আমি বিবৃতি দিতে পারব না। আপনারাই দেন বিবৃতি। কারণ সে আপনাদের সমবয়সী এবং সমতুল্য।’
মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, মাওলানা আবদুল হালিম বুখারী এবং সুলতান যওক নদভি চাচ্ছিলেন আল্লামা আহমদ শফি সাহেব যেন বিবৃতি দেন। তাদেরকে সমর্থন করেন মুফতি আবদুর রহমান রহ.। তাদের কথা না রাখায় ২৩ ফেব্রুয়ারি তারা হেফাজতে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে তারা জানিয়ে দেন, তারা হেফাজতে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করেছেন। ২৪ তারিখ হেফাজতে ইসলাম লালদিঘির ময়দানে যে সমাবেশ ঘোষণা করেছে, ‘তা মূলত জামায়াতে ইসলামির ইন্ধনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’ এরপর সরকার ২৪ জানুয়ারির সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অবস্থার প্রেক্ষিতে ২৪ জানুয়ারি ফজরের পর হাটহাজারি মাদরাসায় একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকে নতুন মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে। সিনিয়র নায়েবে আমির হিসেবে যুক্ত করা হয় মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে। সিদ্ধান্ত হয়—সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও সবাই সমাবেশের উদ্দেশ্যে বেরুবে।
প্রায় ৭০টি প্রাইভেটকারে হাটহাজারি মাদরাসা থেকে সমাবেশের উদ্দেশ্যে বের হয় হেফাজতে ইসলামের কাফেলা। কিন্তু অক্সিজেন পার হয়ে বালুচরা নামক স্থানে পুলিশি বাঁধার সম্মুখীন হন তারা। পুলিশ আল্লামা আহমদ শফি সাহেবের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। এদিন তেরো-চৌদ্দজন আহত হয়, রক্তাক্ত হয়। রক্তের নজরানা দিয়ে শুরু হয় হেফাজতে ইসলামের পথচলা। এই ঘটনার পরই পুরো বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম একদম শুরু থেকে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান পর্যন্ত কেবল চট্রগ্রাম-ভিত্তিক একটি সংগঠন ছিল। তা-ও বৃহত্তর চট্রগ্রামের নয়। তবে দেশের প্রতিটি ধর্মীয় ইস্যুতে সংগঠনটি কথা বলেছে। চট্রগ্রাম প্রেসক্লাবে প্রেস কনফারেন্স করেছে, মিছিল-মানববন্ধন করেছে। দৈনিক পূর্বকোণসহ চট্রগ্রাম-ভিত্তিক বিভিন্ন পত্রিকায় হেফাজতের আমির হিসেবে আল্লামা আহমদ শফির বিবৃতি প্রকাশ হতো।’
শাহবাগ ও হাটহাজারি
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, দুপুর বারোটায় ঘোষিত হয় যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতের আমির আবদুর কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়। আদালতের এই রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আন্দোলনে নামে কতক ব্লগাররা। তারা দাবি জানায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হোক। ব্যাপারটা এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলত। কিন্ত আন্দোলনে মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের ঔদ্ধত্য। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির সঙ্গে তারা তাদের আক্রমণের লক্ষ্য বানায় ইসলাম এবং মুসলমানদের। আন্দোলনের শুরুর দিকে দাড়ি টুপি পরিহিত কোন লোক তাদের পাশ দিয়ে গেলেও তাদের তল্লাশী করা হতো, বোরখা পরা মহিলা দেখলে তাদেরকেও তল্লাশী করা হতো। তাদের ঔদ্ধত্ব এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো—তারা শাহবাগে নাটকের আয়োজন করেছিলো। নাটকে দাড়ি এবং টুপি পরিহিত এক অভিনেতার মাথায় জুতো দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো। এটার মাধ্যমে মূলত মুসলামানদের ধর্মীয় পোশাককেই অবমাননা করে হয়েছে। তাছাড়াও তারা একটা ডামি কুকুরের মাথায় টুপি এবং গালে দাড়ি লাগিয়ে সেটাকে নিয়েও নাটক মঞ্চস্থ করেছিলো।
ক্রমান্বয়ে যখন তারা ইসলামকে আঘাত করতে থাকে, খুঁজতে গিয়ে বের হয় আসল তথ্য। এই আন্দোলনের লিডিং রুলে যারা কাজ করছে, তারা একেকজন নস্তিক্যবাদের প্রচারক। ইসলামকে কটাক্ষ করাই যাদের একমাত্র টার্গেট। বাড়তে থাকা তাদের ঔদ্ধত্য শংকিত করে তুলে বাংলাদেশের মুসলমানদের। ১৪ ফেব্রুয়ারি উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারির বার্ষিক মাহফিলে একযোগে সব বক্তাগণ শাহবাগের ঔদ্ধত্য আচরণের প্রতিবাদ জানান।
মাহফিলে সভাপতির বক্তব্যে জামিয়ার মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, ‘জাতির আবেগ-অনুভূতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নাস্তিক ও ইসলামের দুশমনরা তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করে ইসলামের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। দেশব্যাপী বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা, ব্যভিচার ছড়িয়ে দিয়ে মুসলমানদের ঈমান-আমল ও সভ্যতা-সংস্কৃতি ধ্বংসে নতুন আরেক ষড়যন্ত্র শুরু করছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার হাজারবার হোক, তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে আলেমসমাজ, মাদ্রাসা, দাড়ি-টুপি, পর্দা তথা দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোন ষড়যন্ত্রে এদেশের আলেমসমাজ ও তৌহিদী জনতা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না।’ তিনি সরকারের প্রতি অবিলম্বে ইসলাম, মুসলমান, নামাযী, দাড়ি-টুপিধারীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সকল অপতৎপরতা বন্ধের আহবান জানান।
সম্মেলনে হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সংযোজনের পর থেকে নাস্তিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একের পর এক যেভাবে দুঃসাহস দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক মসজিদে হামলা ও ভাংচুর চালাচ্ছে, আমাদের প্রাণের স্পন্দন হযরত মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে, বয়োবৃদ্ধ দাড়ি-টুপীধারীদের ওপর উঠতি তরুণরা যেভাবে বর্বর আচরণ করছে, তাতে আমরা হতভম্ব ও বিস্মিত না হয়ে পারছি না। নাস্তিক-মুরতাদ ও ক্ষমতাসীন মহলের ইসলাম বিদ্বেষী এ আচরণের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
চট্টগ্রাম বাবুনগর মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা মুহিববুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, কলেজ পড়ুয়া এক তরুণ পুলিশের সামনে একজন বয়স্ক মুরুব্বিকে দাড়ি ধরে যেভাবে মারধর করেছে, এরকম অবস্থা সমাজে আরও ঘটতে থাকলে জমিনে সরাসরি আল্লাহর গযব নেমে আসবে।
চট্টগ্রাম হাইলধর মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা আব্দুল মালেক হালিম বলেন, চরম ইসলাম বিদ্বেষী শাহরিয়ার কবীর, ফতোয়া নিষিদ্ধকারী বিচারপতি গোলাম রব্বানী, ধর্মহীন শিক্ষানীতির অন্যতম প্রবক্তা জাফর ইকবাল গং এবং মহানবী সা. সম্পর্কে অশ্লীল ও অত্যন্ত ঘৃণ্যভাবে গালিগালাজকারী আসিফ মহিউদ্দীনসহ আরও অনেক নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষীরা সরলমনা তরুণ প্রজন্মকে বিপদগামী করার ঘৃণ্য মানসে শাহবাগের নাটক সাজিয়েছে। তারা হয়েছে খলনায়ক।
এই মাহফিলের পর শাহবাগের নাস্তিক্যবাদ-বিরোধী প্রতিবাদ আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেন, ‘এই মাহফিলে লক্ষ মানুষের সামনে প্রমাণসহ শাহবাগ আন্দোলনের নাস্তিক লিডারদের গোঁমর ফাঁস করেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। তারপর থেকেই সারাদেশে জাগরণ শুরু হয়।’
মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘হাটহাজারি মাদরাসার বার্ষিক মাহফিল চলাকালীন, ১৪ ফেব্রুয়ারি সবাই বৈঠকে বসেন। বেঠকে শাহবাগের নাস্তিকদের আস্ফালনের প্রতিবাদ জানানোর কৌশল ও পন্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়।’
হেফাজতের যুগ্মমহাসচিব ও লংমার্চের অন্যতম সংগঠক মুফতী ফয়জুল্লাহ ফাতেহকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে হেফাজতের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেন, ‘২০১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শাহবাগে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে যখন হাজার কয়েক মানুষ সমবেত হলো, এর গোড়ায় ছিল নাস্তিক্যবাদী ব্লগাররা। তারা প্রথমে রাজাকারদের ফাঁসির দাবি তুললেও ক্রমান্বয়ে ইসলাম ও এ দেশের ইসলামি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করে। নানা প্রকারের উস্কানিমূলক ক্রিয়াকর্মের সূচনা করে। ইসলাম ও ইসলামি লেবাস-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। কুকুরের মাথায় টুপি দিয়ে ইসলামি লেবাসকে চরম অবজ্ঞা করে। এমনকি বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও তোলে তারা, যা নিতান্তই অযৌক্তিক এবং অমূলক। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই সময় এই নেতৃত্বের গোড়ায় থাকা লোকজনের ইসলাম এবং ইসলামের মহানবি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সম্মানিত পরিবার নিয়ে চরম বেয়াদবিপূর্ণ ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক লেখাজোখা জনসমক্ষে প্রকাশ হতে শুরু করে। আর এটা তারা অব্যাহতভাবে চালিয়েই যাচ্ছিল। শাহবাগে তাদের অবস্থানের সময় তা আরও ভয়ানক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। তাদের এসব উস্কানিমূলক কার্যকলাপ, যা এ দেশের সিংহভাগ মানুষের বিশ্বাস ও ঈমানে আঘাত হানছিল, রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছিল অসংখ্য নবিপ্রেমিকের হৃদয়ে, তা প্রতিরোধ এবং নবিজির শানে বেয়াদবিমূলক কথাবার্তার শাস্তি স্বরূপ তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতেই মূলত হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে এ দেশের তওহিদি জনতা গর্জে ওঠেন।’
হেফাজতে ইসলামের খোলাচিঠি এবং ১৩ দফা
১৫ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে নিহত হয় ইসলাম এবং মহানবিকে নিয়ে কটূক্তি করে লেখালেখি করা ব্লগার রাজিব ওরফে থাবা বাবা। তার মৃত্যুর পর ইসলামকে আক্রমণ করে শাহবাগের আস্ফালন আরও বেড়ে যায়। এদিকে দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় থাবা বাবার লেখাগুলো প্রকাশের ফলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সর্বত্র। বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি দিয়ে এর তীব্র নিন্দা জানায়। শুরু হয় সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং। ২২ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেইটে হেফাজতে ইসলাম এবং সমমনা ১২টি ইসলামী দলের পক্ষে প্রথম বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশি বাধায় তা পণ্ড হয়ে যায়।
এসময় জাতির উদ্দেশ্যে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফির পক্ষ থেকে একটি খোলা চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু সুশীল মিডিয়া এই খোলা চিঠি নিয়ে নোংরা হৈচৈ শুরু করে। একাত্তর টিভিতে প্রচারিত পলাশ রহমানের ডকুমেন্টারি ‘হেফাজতনামা’য় বলা হয়, ‘খোলা চিঠিটি আহমদ শফির নয়। বরং আমার দেশ পত্রিকার অফিসে চিঠিটি লিখে আহমদ শফির নামে চালিয়ে দেয়া হয়।’আসলেই কি তাই? আমাকে মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘খোলা চিঠিটি একদম নিরেট। আল্লামা আহমদ শফি এই চিঠি লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনজনকে। আমি, মাসিক মুঈনুল ইসলামের সম্পাদক মাওলানা মুনির এবং হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদি। আমরা এই তিনজন পরামর্শ করে চিঠিটি লিখেছি। আল্লামা আহমদ শফি চিঠিতে নিজে সাইন করেছেন। এরপর কোনো পত্রিকা এতে একটি শব্দও যুক্ত করেনি।’
এভাবেই সুশীল মিডিয়া মিথ্যাচার করে থামিয়ে দিতে চেয়েছে হেফাজতে ইসলামের অগ্রযাত্রা। কিন্তু ততদিনে মানুষ জাগতে শুরু করেছে। চারদিকে শুরু হয়েছে হেফাজতের শানে রিসালাত সম্মেলন। বিভিন্ন জেলার আলেমগণ হেফাজতের কেন্দ্রীয় অফিসে ফোন করে স্বেচ্ছায় শানে রিসালাত সম্মেলনের প্রোগ্রাম নিচ্ছেন। চট্টগ্রাম-ভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম হয়ে উঠছে পুরো বাংলাদেশের। অঘোষিতভাবেই হেফাজতে ইসলাম নাস্তিক্যবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে আসনে উঠে আসে। মানুষের আস্থা ও ভরসার জায়গায় পরিণত হয়।
৯ মার্চ হাটহাজারি মাদরাসায় ওলামা সম্মেলনের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। সম্মেলনে সরকারের কাছে ১৩ দফা পেশ করা হয়। এই ১৩ দফা রচনা করেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘আমাকে দেয়া হয়েছিল দফা লেখার দায়িত্ব। সম্মেলনের আগেরদিন রাত তিনটায় দফাগুলো লেখা শেষ হয়। টাইপ এবং প্রিন্টিং করেন মাসিক মুঈনুল ইসলামের সম্পাদক মাওলানা মুনির। তিনি আমাকে বললেন, ‘দাবি বেশি হয়ে গেলো না?’ আমি বললাম, ‘যেহেতু ২০১৩ সালে আন্দোলন করছি, তাই ১৩ দফা দেয়া হয়েছে।’
চট্টগ্রামে ইমরান এইচ সরকারকে বাধাদান
ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলায় গণজাগরণ মঞ্চ তৈরী করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৩ মার্চ চট্টগ্রামে আসার ঘোষণা দেয় শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠক ইমরান এইচ সরকার। তখনই প্রেস ব্রিফিং করে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘ইমরান এইচ সরকারকে চট্টগ্রামে আসতে দেয়া হবে না। সে এলে আমরা যেকোনো উপায়ে প্রতিহত করব।’ এই ব্রিফিংয়ের পর চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের অফিসে ডাক পড়ে আলেমদের। ছয়-সাতজন আলেম উপস্থিত হন। তখন চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার ছিলেন বর্তমানে ঢাকার ডিআইজি শহিদুল হক। তিনি বললেন, ‘ইমরান এইচ সরকার এদেশের নাগরিক। এই দেশের সব জায়গায় যাওয়ার তার অধিকার আছে। আপনি বাধা দিতে পারেন না।’ মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বললেন, ‘দেশের নাগরিককে বাধা দিচ্ছি না। বাধা দিচ্ছি আল্লাহর নবির দুশমনকে। তবুও যদি সে আসে, মদিনা থেকে ডেকে আল্লাহর নবিকে নিয়ে আসব। তিনি এসে তার ইজ্জত তিনিই রক্ষা করবেন।’
আলেমদের অনঢ় অবস্থান এবং বিস্ফোরণ্মুখ পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পুলিশ কমিশনার চট্টগ্রামে কারফিউ জারি করে দিলেন। ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম আসার পথে দুই গাড়ি অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয় ইমরান এইচ সরকারককে।
হেফাজত-চরমোনাই বিতর্ক
৯ মার্চ হাটহাজারি মাদরাসায় অনুষ্ঠিত হয় হেফাজতে ইসলামের ওলামা সম্মেলন। এ সম্মেলনেই ৬ এপ্রিল পুরো দেশ থেকে ঢাকামুখী লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ সম্মেলন থেকেই হেফাজত-চরমোনাই বিতর্ক শুরু।
মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘ওলামা সম্মেলনে বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে চরমোনাই পীর মুফতি রেজাউল করিম একটু অসংযত এবং অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেন। ফলে সম্মেলনে শোরগোল শুরু হয়। এমনকি এই শোরগোল হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যায়। তখন আল্লামা আহমদ শফির নির্দেশেই মাইক বন্ধ করে দেয়া হয়।’
তবে ইউটিউবে প্রকাশিত ওলামা সম্মেলনের ভিডিওতে দেখা যায়, চরমোনাই পীর সাহেবের বয়ানের সময় কোনো অযাচিত শোরগোল ঘটেনি। বরং মুফতি রেজাউল করিম আল্লামা আহমদ শফি সাহেব যে কর্মসূচি দিবেন, তা সবাইকে মেনে নেয়ারও আহ্বান জানান।
মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘এরপর চরমোনাই পীর কার্যত হেফাজতে ইসলামের বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়ে যান। আল্লামা আহমদ শফি এক ধরণের বিবৃতি দেন, তিনি দেন আরেক ধরণের। সর্বশেষ তিনি হেফাজতের লংমার্চের বিপরীতে ৬ এপ্রিল কুয়াকাটামুখী লংমার্চের ডাক দেন। ৬ এপ্রিল হেফাজত ঘোষণা করেছে ঢাকামুখী লংমার্চ, আর চরমোনাই পীর ঘোষণা করেছেন কুয়াকাটামুখী লংমার্চ। এমন সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়েও আল্লামা আহমদ শফি চাইছিলেন, তবুও যেন হেফাজতের সঙ্গে চরমোনাই পীর থাকেন। এ উদ্দেশ্যেই ৫ এপ্রিল, লংমার্চের আগের দিন মাগরিবের পর, ইসলামি আন্দোলনের অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমাদসহ চারজনের সঙ্গে লালবাগে একটি বৈঠক হয়। হেফাজতের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন—মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমি, মাওলানা মাহফুজুল হকসহ আরও কয়েকজন।
বৈঠকে চরমোনাই পীরকে চারটি শর্ত দেয়া হয়। তারমধ্যে অন্যতম তিনটি হলো—১. হেফাজতের বিবৃতির বিপরীত বিবৃতি না দেয়া। ২. আগামিকাল দৈনিক পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে হেফাজতের সঙ্গে সমর্থন ব্যক্ত করা। ৩. কুয়াকাটামুখী লংমার্চ বাতিল করা। কিন্তু শর্তগুলোর একটিও পালন করেননি তিনি। তাই লংমার্চের মঞ্চে দাঁড়িয়ে জুনায়েদ আল হাবিব ঘোষণা করেছিলেন, ‘আপনি শর্ত মানেননি। আপনাকে স্টেজে আসতে দেয়া হবে না।’
এই জায়গায় একটা নোট যুক্ত করতে হয়। ২৯ মার্চ, ২০১৩ ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় মহাসমাবেশে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন চরমোনাই পীর—তা বলছে অন্যকথা। কর্মসূচি লিখিত লিফলেটে দেখা যায়—তিনি সর্বপ্রথম ৬ তারিখে হেফাজতের লংমার্চে সমর্থন জানানোর কথা বলেছেন। এদিন অন্যকোনো কর্মসূচি রাখেননি। তারপর ১৯, ২০ এবং ২১ এপ্রিল লংমার্চ নয়, বরং কুয়াকাটার অভিমুখে রোডমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ৮ এবং ৯ মে ঘোষণা করেছেন মায়ানমার অভিমুখে লংমার্চ।
হেফাজতের ৬ এপ্রিলের লংমার্চ
নাস্তিক-মুরতাদদের শাস্তির দাবিতে ঢাকার ঐতিহাসিক শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ৬ এপ্রিল লংমার্চের আহ্বান করে। ওই দিনই লংমার্চ-পরবর্তী মহাসমাবেশ থেকে ঘোষিত হয়েছিল হেফাজতে ইসলামের ঐতিহাসিক ১৩ দফা দাবি। পাশাপাশি জেলায় জেলায় শানে রেসালত সম্মেলনেরও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এক মাস সময় বেঁধে সরকারকে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছিল—একমাসের ভেতর দাবি না মানলে ৫ মে ঢাকা অবরোধ করা হবে।
দলমত নির্বিশেষে সেই লংমার্চে মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। সেদিন ভোর থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে আসতে থাকে তৌহিদি জনতার বড় বড় কাফেলা। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি এবং শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত করতে থাকেন আশপাশ। শাপলা চত্বরে তৈরি বিশাল মঞ্চ থেকে সারাদিন ধরে বক্তৃতা দেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ। দুপুরের পর শাপলা চত্বরকে ঘিরে পুরো এলাকাটি এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত রাস্তাটি ছিল মানুষের ভিড়ে ঠাসা। মতিঝিলকে ঘিরে আশপাশের রাস্তাগুলোতেও ছিল মানুষের স্রোত। ছোট বড় সকল ইসলামী দল ও তার নেতাকর্মীরা এসেছিল সেই লংমার্চে। প্রায় সকল ছোট বড় নেতারাই বক্তব্য রেখেছেন হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের লংমার্চের মঞ্চে। সেই লংমার্চের পুরো অনুষ্ঠান বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করেছে।
হেফাজতে ইসলাম যদিও এ আন্দোলনকে নিরেট ধর্মীয় আন্দোলন বলে আসছিল, কিন্তু সরকারপক্ষ তারপরও আস্থা রাখতে পারছিল না তাদের ওপর। বাম ঘরানার বিভিন্ন সংগঠনও তৎপর হয়ে ওঠে এ সময়। হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ও মহাসমাবেশ ঠেকাতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ ও বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন হরতাল ও অবরোধ ডেকেছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা শহরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সড়ক এবং রেল যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। লংমার্চে অংশগ্রহণের জন্য ভাড়াকৃত গাড়ির মালিকদের আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়, এ দিন ঢাকা অভিমুখে যাওয়া যাবে না।
বাম ঘরানার হরতাল-অবরোধ এবং প্রশাসন কর্তৃক যোগাযোগ-ব্যবস্থায় এতসবের নিয়ন্ত্রণারোপের পরও ২০১৩-এর ৬ এপ্রিল তৌহিদি জনতার ঢল নেমেছিল রাজধানীজুড়ে। দূর-দূরান্তের পথ পায়ে হেঁটে, ছোট ছোট গাড়ি দিয়ে ভাঙা ভাঙা জার্নি করে তৌহিদি জনতার অনেকে রাজধানীতে এসেছিলেন। অনেকে আসতেই পারেননি।
সিলেট থেকে একাধিক ক্ষুদ্র কাফেলাও সেদিনকার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফাতেহ টোয়েন্টি ফোরকে জানিয়েছে একই রকম অভিজ্ঞতার কথা। এ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা থেকে বড় বড় অনেক কাফেলা তৈরি হয়েছিল লংমার্চে শরিক হবার জন্য। গাড়িও ভাড়া করে রেখেছিল তারা। কিন্তু প্রশাসনিক বাধার কারণে রওনা করতে পারেননি। সিলেট শহরের আল-হেরা হিজামা কটেজের সত্ত্বাধিকারী সাইফ রহমান ফাতেহকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘২০১৩-এর ৫ এপ্রিল সাবেক এমপি মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরীর নেতৃত্বে তওহিদি জনতার বিশাল একটি গাড়িবহর সিলেট শহর থেকে লংমার্চের উদ্দেশে যাত্রা করলে প্রশাসনিক বাধার সম্মুখীন হয়। পরে মাওলানা শাহীনুর পাশা এই বহর নিয়ে পদব্রজে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। অবশ্য এত দূরের পথ এক রাতে এভাবে পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয় বলে তা স্থগিত করে সিলেট শহরে ফিরে আসেন। নগরীর কোর্ট পয়েন্টে বসে ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে গণজমায়েত। পরদিন তা জনসমুদ্রে রূপ নেয়।’
৬ এপ্রিলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আলেম সাংবাদিক ও ত্রৈমাসিক জীবন্তিকার সম্পাদক এহসান সিরাজ বলেন, দল-মত নির্বিশেষে আপামর মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল সেদিনকার কর্মসূচিতে। রাজধানীর ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যার যার মতো করে এ আন্দোলনে সমর্থন জানাচ্ছিল। গরমের সময় ছিল, কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া পিপাসার্ত মানুষকে বিভিন্ন কোমল পানীয় সরবরাহ করছিল তারা দেদারসে। হেফাজতে ইসলামের এটা ছিল প্রথম বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি। এবং তা ছিল নিতান্তই ধর্মীয় দাবি-দাওয়া নিয়ে। প্রথম প্রথম তৃণমূলের অনেক আওয়ামী সমর্থকেরও অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল এর প্রতি। ৬ এপ্রিলের লংমার্চে তা প্রত্যক্ষ করা গেছে। সরকার বিভিন্নভাবে বাধা দিলেও লংমার্চের সময় মারমুখো ছিল না। কিন্তু পরবর্তী এক মাসে দৃশ্য সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের ক্যাডার বাহিনী ব্যাপকভাবে মারমুখো অবস্থান গ্রহণ করে। এর পেছনে মূল কারণটা আমি মনে করি জামায়াত-বিএনপির অতি উৎসাহ এবং হেফাজত নেতৃত্বের ভেতর থেকে কারো কারো সরকার-পতনের আহ্বান-মূলক রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান। বিএনপি চেয়েছিল অতীতের মতো তৌহিদি জনতার কাঁধে সওয়ার হয়ে ক্ষমতায় যেতে। এসব কারণে সরকার এ আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে নিয়েছে এবং ৫ই মের নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়েছে।’
লংমার্চে আমিরে হেফাজত শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা. বা.-এর ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন হেফাজতের যুগ্মমহাসচিব ও লংমার্চের অন্যতম সংগঠক মুফতী ফয়জুল্লাহ। তার কাছে লংমার্চের স্মৃতি জানতে চাইলে তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘স্মৃতি তো আছে অসংখ্য, তবে যে স্মৃতিটা আজও আমাকে আপ্লুত করে এবং যেটার কারণে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, তা হলো—লংমার্চ পরবর্তী মহাসমাবেশে শাপলা চত্বরের মঞ্চ থেকে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি ঘোষণা। আমিরে হেফাজত শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা. বা.- এর ঘোষণাপত্রটি পাঠের দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত করেছিলেন। তাছাড়া হেফাজতে ইসলামের এ মহাজাগরণ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবে, একে সংগঠিত করার পেছনে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা. বা.-এর নেতৃত্বে আমার সম্পৃক্তি এবং এর জন্য নিজেকে নিবেদিত ও উৎসর্গিত করা আমার জীবনের অন্যতম পরম সৌভাগ্য। এ সৌভাগ্যের স্মৃতি আমাকে আজীবন প্রেরণা যোগাবে।’
হেফাজতের ঢাকা অবরোধ ও নৃশংস ট্রাজেডি
৫ মে হেফাজতে ইসলামের কর্মী এবং তাওহিদি জনতা ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে। ঘোষণা অনুযায়ী, এদিন ভোর থেকে তারা প্রথমে ঢাকায় প্রবেশ করার ৬টি রুটে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। দুপুরের পর হেফাজতে ইসলাম এর কর্মীরা তাদের অবরোধ কর্মসূচি গুটিয়ে শাপলা চত্বরে আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে ‘দোয়া কর্মসূচি’ পালন করার জন্য ঢাকায় প্রবেশ করতে শুরু করেন। তাদেরকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এর পক্ষ থেকে দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়। শাপলা চত্বরে আসার পথে পথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সশস্ত্র সমর্থকদের হাতে হেফাজত কর্মীরা আক্রান্ত হন। বিশেষ করে গুলিস্থান হয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে দিয়ে শাপলা চত্বরে আসার সময় আওয়ামী কর্মী এবং সমর্থকরা হেফাজত কর্মীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সশস্ত্র হামলা চালায়। এসময় পুলিশের গুলি ও সরকার সমর্থকদের হামলায় কয়েকশ হেফাজত কর্মী আহত এবং ৩ ব্যক্তি নিহত হন। হেফাজত কর্মীরা ইট-পাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন। এরপর দুপুর আনুমানিক ৩টা থেকে তারা সমাবেশ শুরু করেন এবং পর্যায়ক্রমে সেখানে অবস্থানকারী নেতারা সরকারের কাছে তাদের দাবী-দাওয়া এবং সেই সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন। এইভাবে চলতে থাকে তাদের এই সমাবেশ।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশ ভেঙ্গে ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেন। এই সময়, বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি জানানোর নাগরিক অধিকারের প্রতি সমর্থন জানায়। হেফাজতের শান্তিপূর্ণ অবরোধ ও ঢাকা প্রবেশের সময় পথে পথে তাদের নেতা কর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলা ও অনেক মানুষ আহত ও ৩ জন নিহত হবার পর হেফাজত আরও অনড় অবস্থানে চলে যায়। হেফাজতের নেতা কর্মীরা বলতে থাকেন, আল্লামা শফী মতিঝিল শাপলা চত্বরে এসে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান কর্মসূচী চালিয়ে যাবেন। সন্ধ্যার পরও হেফাজতের নেতারা সমাবেশে বক্তৃতা করছিলেন। তবে রাত আনুমানিক ৮ টায় এশার নামাযের আগে এই বক্তৃতা থেমে যায়। এরপর রাত আনুমানিক ৮.৩০ টায় পুলিশের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের মতিঝিল থানা ও এর আশেপাশে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশ হেফাজত কর্মীদের লক্ষ্য করে গুলি করে।
কথা ছিল আমিরে হেফাজত এসে দোয়া করে সমাবেশ সমাপ্ত করবেন। রাত সাড়ে দশটায় পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রধান শাহ আহমদ শফিকে লালবাগ মাদ্রাসা থেকে নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু কিছুটা পথ এসেই অসুস্থ এবং নিরাপত্তার অভাবের কথা বলে শাহ আহমদ শফিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। ফলে কর্মীদের রাতেও সেখানে অবস্থান করতে হয়। রাত আনুমানিক ১১ টায় শাপলা চত্বরের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হেফাজতের কর্মীরা যে যেখানে ছিলেন সেখানেই রাস্তার মাঝে বসে পড়েন, অনেক হেফাজত কর্মী গায়ের পাঞ্জাবি খুলে অথবা সঙ্গে থাকা ব্যাগ কিংবা জুতা কাপড়ে পেঁচিয়ে মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আবার অনেকেই সেখানে বসে জিকির করতে থাকেন।
১১ জুন ২০১৩ রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা কাজ করেছি; অবরোধ ও সমাবেশ করেছি। তবে রাতে অবস্থানের কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বাধ্য হয়েছি। কারণ—দিনের বেলায় যখন আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর বিভিন্ন জায়গায় সরকারি দলের লোকেরা আক্রমণ করে এবং অব্যাহতভাবে সেই আক্রমণ চলতে থাকে, এভাবে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমাদের বহুসংখ্যক কর্মী কখনও ঢাকায় আসেনি, এখানকার রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না। তার ওপর সরকারি বাহিনীর হামলা। ফলে এই ধরনের আক্রমণাত্মক অবস্থার মধ্যে আমরা আমাদের কর্মীদের কোথায় ছেড়ে দেব? তাছাড়া কথা ছিল—আমাদের আমির এসে আখেরি মুনাজাত করবেন এবং আমাদেরকে বিদায় জানাবেন। কিন্তু আমাদের আমিরকে আসতে দেয়া হয়নি। উনি আসছেন, রওয়ানা হয়েছেন—এভাবে নানা ঘোষণা আসে। আমরা উনার আসার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু ওখানে আসতে বাধা দেয়া হলো, উনাকে আসতে দেয়া হলো না। এভাবে মাগরিব ছাড়িয়ে গেল। উনাকে পথ থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে আমরা আটকে পড়লাম। পরবর্তীতে জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব এসে উনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে বললেন, ‘আমির মাওলানা আহমদ শফি সাহেবকে আসতে দেয়া হয়নি, উনাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এখন মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে এই সময় উনার আসাটাও ঠিক হবে না। আর রাতের বেলা আপনারা কোথায় যাবেন। আপনারা এখানে অবস্থান করেন। সকাল ৬ টার পর হুজুর আসবেন।’ এই ঘোষণা সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে। ফলে আমাদের এখানে অবস্থান করার কোনো ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমরা পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছি সেখানে অবস্থান করতে।
এদিকে পুলিশ, র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর সদস্যরা ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে সেখানে হামলার পরিকল্পনা করে। যৌথবাহিনীর সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে রামকৃষ্ণ মিশন (আর কে মিশন) রোডটি বাদ দিয়ে দৈনিক বাংলা মোড় থেকে ১টি, ফকিরাপুল মোড় থেকে ১টি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে বের হয়ে মূল মঞ্চের দিকে ১টি—এই মোট ৩টি দলে ভাগ হয়ে একযোগে শাপলা চত্বরে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরই শুরু করে টিয়ারগ্যাস, গুলি, সাউন্ডগ্রেনেডসহ বিরতিহীন আক্রমণ। আর কে মিশন রোডটি দিয়ে অভিযান না চালানোর উদ্দেশ্য ছিল—যাতে হেফাজত কর্মীরা আর কে মিশন রোড দিয়ে পালিয়ে রাজধানীর বাইরে চলে যেতে পারেন।
৬ মে রাত আনুমানিক ১২.৩০ টায় মতিঝিলের প্রতিটি রাস্তার বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে চারদিক অন্ধকার করে দেয়া হয় এবং এই সময় সমাবেশ করার জন্য ব্যবহৃত মাইকের সংযোগও কেটে দেয়া হয়। যৌথবাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় রাত আনুমানিক ২.১৫ টায় হেফাজত কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শাপলা চত্বর ও এর আশে পাশে থাকা নিরস্ত্র এবং ঘুমন্ত হেফাজত কর্মীদের ওপর নির্বিচারে গরম পানি, টিয়ারসেল, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং গুলি ছুঁড়তে থাকে। যৌথবাহিনী রাতের এই অপারেশনের তিনটি সাংকেতিক নাম দেয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় ‘অপারেশন শাপলা’, র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয় ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ এবং বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয় ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’। ৬ মে ২০১৩ বিভিন্ন থানার পুলিশ বাদি হয়ে মতিঝিল থানায় ৬টি, পল্টন থানায় ১২টি এবং রমনা থানায় ১টি মামলা দায়ের করে। এরপর ৭ মে ২০১৩ পল্টন থানায় আরো ৪ টি মামলা দায়ের করা হয়। এক্ষেত্রে ১৮৬২ জন সহ অন্তত ১৩৩০০০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় ।
লেঃ কর্ণেল কিসমত হায়াত, পরিচালক, র্যাব-১, ঢাকার বরাতে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ মে ২০১৩ রাত আনুমানিক ২.১৫ টায় র্যাব সহ যৌথবাহিনী রাজারবাগ মোড় হয়ে ফকিরাপুল থেকে অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে প্রায় ১৫০০ র্যাব সদস্য অংশ নেয়। র্যাবের পক্ষ থেকে এই অভিযানের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’। অভিযান চলে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে। তিনি র্যাব-১ এর নেতৃত্ব দেন। র্যাব-৩ এর পক্ষ থেকে অধিনায়ক মেজর সাব্বির, র্যাব-৪ এর পক্ষ থেকে পরিচালক কামরুল হাসান এবং র্যাব-১০ এর নেতৃত্ব দেন অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল ইমরান। তিনি বলেন, সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাত ২টা ১৫ মিনিটে অভিযান শুরু হয়। প্রথমে পুলিশের ১টি রায়ট কার ও ১টি জলকামানকে সামনে রেখে র্যাব ও পুলিশ গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা মুহুর্মুহু টিয়ার শেল আর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। একই সঙ্গে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও শটগানের গুলির প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে মতিঝিলসহ আশপাশ এলাকা। গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের তোপের মুখে মঞ্চ ছাড়তে শুরু করে হেফাজতের নেতারা। কেউ কেউ চলে যায় টিকাটুলির দিকে। আবার কেউ চলে যায় সোনালী ব্যাংকের ভেতরে, কেউ পাশের ভবনে, কেউ বা অলিগলিতে। হেফাজতের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে র্যাব-পুলিশের পরনে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।
মহসিন খান, পাবলিক রিলেশনস অফিসার, বিজিবি, পিলখানা, ঢাকার বরাতে অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ মে ২০১৩ শাপলা চত্বরে যৌথবাহিনীর অভিযানে বিজিবি সদস্যরা অংশ নেয়। তবে বিজিবি সদস্যরা অপারেশনে নিযুক্ত পুলিশ অফিসারের নির্দেশ মত কাজ করে। এই অভিযানকে বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয় ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’। এই অভিযানে কতজন বিজিবি সদস্য ছিল তা তিনি জানাতে পারেননি।
শাপলা চত্বরের অভিযানটি পরিচালিত হয় রাত আড়াইটার দিকে। অভিযানের রেকর্ডেড ভার্সন এই সরকারের সময় লাইসেন্স পাওয়া দুটো টিভি চ্যানেল (সময় ও ৭১) তাৎক্ষণিকভাবে প্রচার করে। পুলিশি অভিযানটি লাইভ সম্প্রচার করে কেবল দিগন্ত টিভি, যার মালিক জামায়াতের একজন নেতা। দিগন্ত টিভির সমপ্রচারে অভিযানের ভয়াবহতা বেশি দৃশ্যমান ছিল এবং টিভিটির নেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকারে শত শত প্রাণহানির দাবি করা হয়েছিল। চ্যানেলটির সম্প্রচার প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে সরকার বন্ধ করে দেয়, অনুরূপ কারণে বন্ধ করে দেয় বিএনপিপন্থী চ্যানেল ইসলামিক টিভির সম্প্রচারও।
সরকার প্রথমে কেউই হতাহত হয়নি বলে দাবি করেছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সেদিন রাতের অভিযানের ছবি ও নির্বিচারে মানুষ হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় সরকার সেই দাবি থেকে সরে আসে এবং সারা দিন বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্ঘাতে তিনজন পথচারী, একজন পুলিশ সদস্যসহ মোট ১১ জন নিহত হওয়ার কথা জানায়। আল-জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল ৫০ জন নিহত হবার কথা জানিয়েছে।
মাইন উদ্দিন খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবালয় অধিকারকে বলেন, ৬ মে ২০১৩ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যে অভিযান চালানো হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে সেই অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’। এই অভিযানের প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে তার স্বাক্ষরিত একটি প্রসনোট ১১ মে ২০১৩ প্রকাশ করা হয়। তিনি বলেন প্রেসনোটেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কাছে থাকা সব তথ্য দেয়া আছে। স্বরাষ্ট মন্ত্রনালয়ের প্রেসনোটের কিছু অংশ এমন: ‘গত ৫ মে ২০১৩ হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক ঢাকা অবরোধ এবং তৎপরবর্তী শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিভিন্ন মহল কর্তৃক কিছু মিডিয়ায় প্রচারিত/প্রকাশিত কথিত গণহত্যা/লাশ গুম ইত্যাদি ধরনের গুজবকে কেন্দ্র করে জনমনে বিরাজমান বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য প্রকৃত সত্য উন্মোচনকল্পে সরকার সংশ্লিষ্ট প্রকৃত তথ্যাদি প্রকাশ করা প্রয়োজন বলে মনে করছে। …রাত প্রায় ২টায় ঢাকা মহানগর পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযান শুরু হয়। অভিযানে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়। অভিযানের শুরুতেই মাইকে একাধিকবার সতর্ক করে সবাইকে চলে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। আরামবাগ ও দৈনিক বাংলা মোড় থেকে শাপলা চত্বরমুখী সড়ক দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আস্তে আস্তে এগোতে থাকে এবং ইত্তেফাক মোড় অভিমুখী রাস্তা খোলা রেখে জনতাকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। অভিযান শুরুর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে অবস্থানরত জনতা শাপলা চত্বর ছেড়ে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ীর পথে সরে যায়। অভিযানকালে মঞ্চের র পাশে কাফনের কাপড়ে মোড়ানো চারটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুলিশ সূত্রে জানা যায় সারা দিন বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্ঘাতে তিনজন পথচারী, একজন পুলিশ সদস্যসহ মোট ১১ জন নিহত হন।’
হেফাজতে ইসলামের নৈতিক বৈধতা
নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার পর সুশীল মিডিয়াগুলো বরাবরই চেয়েছে হেফাজতে ইসলামের নৈতিক বৈধতা ধ্বসিয়ে দিতে। একযোগে তারা প্রচার করেছে—যুদ্ধাপরাধের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলন দমাতেই হেফাজতে ইসলামের নাস্তিকবিরোধী আন্দোলন শুরু। শাহবাগ আন্দোলনের লিডিং রুলে যারা, তারা নাস্তিক নয়। এমনকি ব্লগার আরিফ জেবতিক বলেছিল, ‘ব্যক্তগতভাবে কেউ যদি নস্তিক হয়েও থাকে, তার দায় এই আন্দোলনের ওপর পড়বে না। শাহবাগের আন্দোলন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আন্দোলন।’ (একাত্তর টিভি)
প্রখ্যাত আলেম এবং লেখক মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে—হেফাজতে ইসলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে শাহবাগের আন্দোলন থামাতে মাঠে আসেনি। বরং এই আন্দোলন থেকে ক্রমাগত যখন ইসলামকে আক্রমণ করা হয়েছে, টুপি-দাড়িকে অপমান করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছে হেফাজত। আন্দোলনের লিডিং রুলে থাকা কেউ ব্যক্তিগতভাবে নাস্তিক হলে তার দায় শাহবাগ আন্দোলনের নেতারা নিবেন না, তা বলে পার পাওয়া যাবে না। কারণ, তারা বারবার প্রমাণ করেছে, তারা নাস্তিকদের পক্ষে। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কিছু বলা হলেই শাহবাগ তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। নাস্তিকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এমনকি পত্রিকায় বিবৃতিও দিয়েছে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে—তর্কের খাতিরে যদিও ধরা হয় শাহবাগের আন্দোলন থামাতেই হেফাজত মাঠে নেমেছে, তবুও হেফাজতের আন্দোলন বৈধ। কারণ, শাহবাগের আন্দোলনের জন্মই হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে অসম্মান করে। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
আবদুল কাদের মোল্লার শাস্তি বাড়ানো কিংবা কমানো নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। আমি শুধু বলছি—এমন তো নয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছিল না। বিচার না হলে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো কিভাবে? সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন—এটা একটা ফাঁপা বুলি ছিল। মানুষকে বিভ্রান্ত করার ভেলকিবাজি ছিল। যারা আদালতকে অসম্মান করে রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেছে, তাদের দমাতে হেফাজত আন্দোলন করে থাকলেও হেফাজতের আন্দোলন বৈধ। হেফাজত মূলত রাষ্ট্রের পক্ষে, আদালতের পক্ষে লড়াই করেছে।’
ট্রাডেজির পর
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ৫ই মে হেফাজতে ইসলামীর সেই সমাবেশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বেশ বিচলিত করে তোলে। হেফাজতে ইসলামের সেই সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতার মামলা দায়ের করা হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বিরুদ্ধে তখন বড় আকারের কোন ধড়-পাকড়ে যায়নি। সংগঠনটির কিছু কেন্দ্রীয় নেতাকে আটক করা হলেও কিছুদিন পরে তাদের জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর হেফাজতে ইসলামের সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক ধরণের ‘সমঝোতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ দৃশ্যমান হয়।
২০১৩ সালের ৫ই মে সমাবেশের এক বছরের মধ্যেই হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন আমীর প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক ধরণের সমঝোতা তৈরি হয়েছিল। উভয় পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতায় কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমানের মর্যাদা দেয় সরকার। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে তখনকার হেফাজতে ইসলাম প্রধান আহমদ শফীর সভাপতিত্বে আয়োজিত এক ‘শোকরানা মাহফিলেও’ যোগ দেন শেখ হাসিনা। হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে সুপ্রিম কোর্টের সামনের অংশ থেকে একটি ভাস্কর্যও সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু সরকারের সাথে আহমদ শফীর সে সখ্যতা হেফাজতে ইসলামের ভেতরে অনেকে পছন্দ করতেন না। এসব অপছন্দের বিষয়গুলো তখন অনেকটা ‘সুপ্ত অবস্থায়’ ছিল বলে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন আলেম লেখক ও সম্পাদক লেখক শরীফ মোহাম্মদ।
আহমদ শফীর মৃত্যুর পরে হেফাজতে ইসলামের ঐক্যে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়। তার মৃত্যুর পর জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটির সাথে সরকারের বেশ দূরত্ব ছিল। এরপর ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতির দিকে যায়।
হেফাজতে বিভক্তি, নেতৃত্বের পালাবদল
১৮ সেপ্টেম্বর হেফাজতে ইসলামের আমীর শাহ আহমদ শফী মারা যান। এরপর থেকেই আমীর নির্বাচন নিয়ে সংগঠনটির মধ্যে নানা আলোচনা শুরু হয়। বহু আলোচনা-সমালোচনার পর অনুষ্ঠিত হয় ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের’ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল (সম্মেলন)। চট্টগ্রামের আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা মিলনায়তনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেখানে আগের কমিটি পূর্ণ বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি করা হয়। সম্মেলনে আমীর মনোনীত হন সংগঠনটির মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। মহাসচিব মনোনীত হন জমিয়ত মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী।
এর আগে সম্মেলনে আল্লামা শফীর জীবদ্দশায় হেফাজত থেকে পদত্যাগকারী সংগঠনটির সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে ১২ সদস্যদের সাব কমিটি হেফাজতের নতুন এই কমিটির প্রস্তাব দেন। কমিটিতে ৩২ জন নায়েবে আমির, ৪ জন যুগ্ম মহাসচিব, ১৮ জন সহকারী মহাসচিবের পদ ঘোষণা করা হয়। নতুন কমিটিতে আল্লামা শফী অনুসারী হিসেবে পরিচিতদের অনেককেই বাদ দেয়া হয়। বাদের তালিকায় উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন—হেফাজতের প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাস মাদানী, ইসলামী ঐক্যজোটের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসনাত আমিনী, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ও হেফাজতের যুগ্মমহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, ইসলামী ঐক্যজোটের চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি ও যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী। এছাড়া আল্লামা শফীর বিশস্ত হিসেবে পরিচিত বেফাকের সাবেক কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুসকে হেফাজতের নায়েবে আমীর থেকে বাদ দেয়া হয়। চট্টগামের ঐতিহ্যবাহী নাজিহাট মাদ্রাসার সাবেক মুহতামিম হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা সলিমুল্লাহও নব গঠিত কমিটি থেকে বাদ পড়েন। বিপরীতে স্থান পায় ২০ দলীয় জোটভূক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও সাবেক শরীক দল খেলাফত মজলিসের নেতারা।
হেফাজতের তৎকালীন নায়েবে আমীর মুফতি ওয়াক্কাস এ কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমি কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির, ঢাকা মহানগরী কমিটির প্রধান উপদেষ্টা অথচ আমাকে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু জানানো হয়নি। একটি বিশেষ মহলের ইন্ধনে এ কাউন্সিল হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। আল্লামা শফীর অবর্তমানে এখন একজন আমীর নিযুক্ত করাই ছিল প্রধান কাজ। কিন্তু তা না করে পুরো কমিটি বিলুপ্ত করা হল। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভাবে একটি বিশেষ মহলের ইন্ধনে এটি করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়। যারা চায় না দেশের আলেমরা এক থাকুক।’
সংগঠনটির মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর মৃত্যুর পর শূন্য হওয়া মহাসচিব পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পান হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদী। একইসঙ্গে আলোচিত সংগঠনটির ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কমিটিও ঘোষণা করা হয়। এতে মাওলানা মামুনুল হককে ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি করা হয়। ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর (বুধবার) চট্টগামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় এক বিশেষ বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২৬ মার্চ, ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সেই বিক্ষোভ ঘিরে তৈরী নানা ঘটনার জেরে ২৫ এপ্রিল, ২০২১ সালে হেফাজতে ইসলামের চলমান কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন সংগঠনটির আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। বাবুনগরী বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শক্রমে বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হল। ইনশাআল্লাহ, আগামীতে আহ্বায়ক কমিটির মাধমে আবার হেফাজতে ইসলামের কার্যক্রম শুরু হবে।
২৬ এপ্রিল ৫ সদস্য বিশিষ্ট নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে দলটি। হেফাজতের নতুন আহ্বায়ক কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হন আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী, আহ্বায়ক জুনায়েদ বাবুনগরী ও সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী, সদস্য আল্লামা সালাউদ্দিন নানুপুরী ও অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী। প্রথমে ৩ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর রাত পৌনে ৪টার দিকে সদ্যঘোষিত হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী তার ফেসবুক পেজে এসে এক ভিডিও বার্তায় পূর্বোল্লিখিত আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য হিসেবে আল্লামা সালাউদ্দিন নানুপুরী ও অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে জানান।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের এক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর, ৭ জুন, নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করে দলটি। খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে আগের কমিটির আহ্বায়ক জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির এবং সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদীকে মহাসচিব করা হয়। এছাড়া হেফাজতের প্রয়াত আমীর শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে মো. ইউসুফকেও রাখা হয়। তাকে সহকারী মহাসচিব পদ দেওয়া হয়। কমিটিতে মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মাওলানা সালাউদ্দিন নানুপুরী, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান, মাওলানা মুহিব্বুল হক (সিলেট), মাওলানা আবদুল কুদ্দুসসহ (ফরিদাবাদ) কয়েকজনকে নায়েবে আমির করা হয়। কমিটি থেকে বাদ পড়ে সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, নাছির উদ্দিন মুনির, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, কেন্দ্রীয় নেতা জাকারিয়া নোমান ফয়জী, খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, হাসান জামিল, মুফতি হারুন ইজহারসহ নানা ইস্যুতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া হেফাজতের নেতারা। একইভাবে আল্লামা আহমদ শফীর ‘হত্যা মামলা’র অভিযুক্ত নেতাদেরও বাদ দেওয়া হয় কমিটি থেকে। এছাড়া সদ্য বিলুপ্ত কমিটিতে একক আধিপত্য বিস্তারকারী ‘রাবেতা’ ও ‘জমিয়ত’ সিন্ডিকেটও ভেঙে দেওয়া হয়।
সর্বশেষ দলটির মহাসচিব আল্লামা নূরুল ইসলাম জিহাদীর মৃত্যুর পর শূন্য হওয়া মহাসচিব পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পান হেফাজতের প্রথম যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান। দলটির দ্বিতীয় আমির আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীর ইন্তেকালের পরের রাতেই ভারপ্রাপ্ত আমির নির্বাচিত হন আল্লামা শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী সম্পর্কে জুনাইদ বাবুনগরীর মামা হন। প্রয়াত জুনাইদ বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে তিনি প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। এছাড়া হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে তিনি সিনিয়র নায়েবে আমির ছিলেন।
দাবির বিচারে হেফাজত কতটা সফল?
হেফাজতের যে দাবিগুলো ছিল সেগুলো এ কয় বছরে কতটা অর্জিত হয়েছে? দাবির বিচারে হেফাজতকে কতটা সফল বলা চলে? জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ হেফাজত ইসলামের অন্যতম নেতা, মাদানী নগর মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি বশীরুল্লাহ বলেন, ৬ এপ্রিল লংমার্চ সফলভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ৫ মে শাপলা চত্বরে ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে আমাদের কিছু ভুলের কারণে আশানুরুপ ফলাফল যদিও আসেনি কিন্তু তারপরও বিষয়টাকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাই।’
তিনি বলেন, আমি মনে করি, হেফাজতের আন্দোলন অনেকাংশেই সফল। আমাদের দাবি ছিল, হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম রক্ষার্থে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু আমাদের দাবি মেনে না নিলেও সরকার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, মুসলমান হিসাবে নবীকে কটূক্তি করলে তার নিজের গায়েও লাগে। আমাদের দাবি পুরোপুরি না মানা হলেও কোটিকোটি টাকা ব্যয় করে সরকার শিক্ষা সিলেবাসে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি আমাদের দাবি মোতাবেক না দিলেও তাদের শাস্তির একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। আন্দেোলনের ফলে দেশের গণমানুষের ভেতরে নাস্তিক মুরতাদদের প্রতি এই পরিমাণ ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে নাস্তিকরা প্রকাশ্যে আসতে ভয় পায়। এই আন্দোলনের ফলে আলেম সমাজ জনসাধারণ এবং সরকারের আস্থার পাত্রে পরিণত হয়েছে ।’