৫ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম মিলনায়তনে তরুণ আলেম প্রজন্ম-২৪ এর উদ্যোগে “সংবিধান সংস্কার: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা” শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তরুণ আলেম প্রজন্ম-২৪ এর পরিষদ সদস্য এহসানুল হকের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য রাখেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ফয়সল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, নির্বাহী কমিটির সদস্য মেহরাব হোসেন সিফাত, শেখ সাব্বির এবং সংগঠনটির নির্বাহী পরিষদ সদস্য, মাবরুরুল হক, রফিকুল ইসলাম আইনী, সানাউল্লাহ খান প্রমুখ।
সংগঠনের পরিষদ সদস্য হুজাইফা ওমরের সঞ্চালনায় আলোচনা সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিষদ সদস্য বিলাল আহমেদ চৌধুরী। সভায় মুখ্য আলোচক হিসেবে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক ও গবেষক, কবি মাওলানা মুসা আল হাফিজ (প্রবন্ধের কপি সংযুক্ত)। এরপর অন্যান্য বক্তাগন সংবিধান সংস্কার নিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা তুলে ধরেন।
জমিয়ত মহাসচিব বলেন, একটি চিহ্নিত মহল আমাদের সরকারকে ব্যর্থ করতে চায়। তারা ইতিহাস মুছে দিতে চায়, তারা সংবিধানকে দলীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলতে চায়। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার যতগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কমিশন হচ্ছে, সংবিধান সংস্কার কমিশন। অতএব, এই কমিশনের কাছে প্রত্যাশা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের আকাঙ্খা ব্যক্ত হয়েছে, তা যেন সংস্কার পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দলমত নির্বিশেষে জনসাধারণের সন্তোষ চিত্তে প্রস্ফুটিত হয়।
খেলাফত যুগ্ম মহাসচিব বলেন, সংবিধান তার ন্যায্যতার পক্ষে যে যুক্তি হাজির করে তা হলো, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন।’ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ খেদিয়ে নিজেদের অভিপ্রায় ঘোষণা করেছে। গণবিপ্লব গণইচ্ছার যে সূত্রসমূহ নিয়ে হাজির হয়, সেটাই বিদ্যমান পরম অভিপ্রায়। সেই অভিপ্রায়ই প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন রচনা করবে। সাবেকী সংবিধানের ধারাবাহিকতা কিংবা সাংবিধানিক শূন্যতার যুক্তি এখানে চালক হতে পারে না। বরং বিপ্লব বা অভ্যুত্থান যে গাঠনিক ন্যায্যতা ও ক্ষমতা ধারণ করে, তার মৌলিক দাবি হলো রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের পরিগঠন ও আইনি বিনির্মাণ।
যে সংবিধান ব্যবহার করে ‘ফ্যাসিস্ট’ রেজিম জারি থেকেছে, বিপ্লবের পর সেই সংবিধান গুরুত্ব হারিয়েছে। বিপ্লব ছিল এই রেজিমকে প্রত্যাখ্যানের গণঘোষণা, যা সংবিধানের আওতায় ঘটেনি। ফলে বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ এই সংবিধানের কর্তৃত্ব কবুল করবে কোন গণইচ্ছার বলে?
বস্তুত এই সংবিধানের কর্তৃত্বের অর্থ হলো বিগত রেজিমকে জারি রাখা এবং বিপ্লবীদের জন্য ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত করা। নাগরিকদের পরম অভিব্যক্তি যে সংবিধান, সেটি কিন্তু নাগরিকদের ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। নাগরিকরা বরং প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাহী বিভাগের প্রজা হয়ে আছেন।
ফলে সংস্কারের গণদাবি বিপ্লবের মধ্যে প্রতিফলিত। তবে টেকসই সাংবিধানিক সংস্কারের স্বার্থে আমাদের সব গণপ্রতিনিধিত্বশীল পক্ষকে একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে উপনীত হতে হবে। ন্যূনতম ঐকমত্য নিশ্চিত করেই সংস্কার সম্পন্ন হতে হবে। যে কমিশন গঠিত হয়েছে, সেটি সংবিধানের খসড়া প্রস্তাবনা হাজির করবে। সেটি বলবৎ করার জন্য জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সাংবিধানিক অ্যাসেম্বলি গঠন করতে হবে। সেই অ্যাসেম্বলি বিস্তারিত প্রক্রিয়া এবং বিতর্ক-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংবিধানে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন, পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্লিখনসমূহের চূড়ান্ত ন্যায্যতা দেবে। সংস্কারকৃত সংবিধানের ভিত্তিতে হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এটাই সম্ভবত হতে পারে সংস্কারের গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া।
আরিফ সোহেল বলেন, রাষ্ট্রের সংবিধানে যদি রাষ্ট্রের সকল জনগোষ্ঠীর আকাঙ্খার প্রতিফলন না ঘটে তবে সেটি সংবিধান হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়না। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিলিপি হিসেবে সৃষ্ট ৭২ এর সংবিধানে আমাদের দেশের ইসলামিক জনগোষ্ঠীর আকাঙ্খা ফুটে ওঠেনি। এখন সময় এসেছে সকল নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর প্রতি দায় শোধ করার। ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশ হবে ইনসাফের বাংলাদেশ।
নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাবরুরুল হক বলেন, ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীনতা লাভ করেছে, পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে proclamation of independence সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু ৭২ এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে মুসলিম জাতীয়তাবাদকে মুছে ফেলা হয়েছে, আমাদের সংবিধান প্রত্যাশা হলো ৭২ সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন।
বক্তারা বলেন, সংবিধানের শুরুতেই আছে- বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। কুরআনের আয়াতটি ভুলভাবে লেখা হয়েছে। আসলে তা হবে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এর অর্থ হিসেবে লেখা হয়েছে- দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহের নামে। এই তর্জমা চলনসই হলেও বাক্যটি সঠিক নয়। হবে- দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম যেহেতু কুরআনের আয়াত, তাই তা শুরুতে আরবিতে লিখে ব্র্যাকেটে বাংলায় লিখে অর্থ উল্লেখ করাই উত্তম হবে।)